Header Ads

test

himaloy hill


• অজানা রহস্য • দুর্গম গিরি হিমালয়ের জয়!!! সালটা ছিল ১৯৫৩. রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ সিংহাসনে বসলেন জুনে। সে বছর থেকেই ইউরোপবাসীর চোখে ঘুম নেই। কিছু বিস্ময়কর অর্জন দিয়ে রানির এই সিংহাসনে আরোহণটাকে তো স্মরণীয় করে রাখতে হবে। কিন্তু কীভাবে? অর্জনটা কী হতে পারে? চন্দ্রজয়? কিন্তু সেক্ষেত্রে তো ব্রিটিশদের তেমন কোনো অগ্রগতিই নেই। তাহলে কি রানির এই মুকুট পরার বছরটা কিছু দিয়েই স্মরণীয় করা যাবে না? এমন চিন্তায় যখন ব্রিটিশ রাজদরবার তোলপাড়, তখন হঠাত্ পণ্ডিতদের চোখ গিয়ে ঠেকল দুর্গম গিরি হিমালয়ের দিকে। বেশ তোড়জোড় করে কীভাবে ব্রিটিশদের দ্বারা এভারেস্টজয় সম্ভব হয়— এ নিয়ে ভাবনা শুরু হলো। ব্রিটিশ রাজদরবারের দৃঢ় প্রত্যয়— ব্রিটেন কিংবা তার অধীনে থাকা কোনো দেশ না পারলেও কমনওয়েলথভুক্ত একটা দেশকে এ বছর এভারেস্ট জয় করতে হবেই। রানির সিংহাসনে আরোহণের মান রাখতেই কিনা জানা নেই, তবে এভারেস্টজয় ওই বছরই কিন্তু সম্ভব হয়েছিল। নিউজিল্যান্ডের পর্বতারোহী এডমন্ড হিলারি এবং নেপালের তেনজিং নোরগে ১৯৫৩ সালের ২৯ মে হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে গিয়ে দাঁড়ান। সেখান থেকে তারা যে পৃথিবীটাকে দেখেছিলেন, এভাবে এর আগে কেউই দেখতে পারেননি। সেই শুরু। এখন ২০১৩. এভারেস্টের রহস্য উন্মোচিত হলেও এখনো অনেকের নেশা পৃথিবীর সর্বোচ্চ সেই শৃঙ্গে গিয়ে দাঁড়ানোর। সেখান থেকে পৃথিবী দেখার, সেই নরম বরফে পা রেখে মেঘগুলোকে ছুঁয়ে দেখার। সেই দুর্গম পর্বতজয়ে এখনো আগ্রহের কমতি নেই। অনেকের কাছে এখনো সেই পর্বত অধরা। ৬০ বছর হয়ে গেল, এভারেস্ট জয়কে জড়িয়ে জন্ম নিল নানান কাহিনীর। কখনো সে কাহিনী জয়ের আনন্দে গা কাঁপিয়ে দেয়, কখনোবা অধরা স্বপ্ন নিয়ে বরফের পাহাড়ে মৃত্যুর গল্প হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এভারেস্ট মানেই পৃথিবী ছাড়িয়ে ঐশ্বরিক কোনো অনুভূতির কাছাকাছি চলে যাওয়া। এর মানে হয়তো যারা পাহাড়ের চূড়ায় না দাঁড়িয়েছেন তাদের পক্ষে বোঝা কঠিন। পাহাড় জয় করা একসময় বেশ দুঃসাধ্য বিষয় হলেও বর্তমানে প্রযুক্তির কল্যাণে কিছুটা সহজ হয়ে এসেছে হাজার ফুট উঁচুতে ওঠার কৌশলটা। একেবারে হিমালয়জয় সম্ভব না হলেও প্রশিক্ষণ আর প্রযুক্তির সাহায্যে মূল শৃঙ্গের বেশ কাছাকাছি এখন যাওয়া খুব কঠিন কিছু নয়। এভারেস্টজয়ের ৬০তম বছরে এসে সম্প্রতি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। যেখানে দেখা গেছে, দিন দিন বাড়ছে এভারেস্টজয়ীর সংখ্যা। ১৯৯০ সালে যেখানে এভারেস্টে ওঠা ১৮ শতাংশ পর্বতারোহী এর মূল শৃঙ্গে পৌঁছতে পারতেন, সেখানে ২০১২ সাল নাগাদ সে সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৬ শতাংশে। মানুষের ক্রমবর্ধমান এ রোমাঞ্চপ্রেমকে সাধুবাদ জানান গবেষকরা। পাশাপাশি তাদের মনে জন্মেছে যথেষ্ট শঙ্কাও। কারণ হিমালয়জয়ের জন্য উত্সুক পর্বতারোহীদের চাপে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সেখানকার পরিবেশে। সেখানকার শ্বেত-শুভ্র বরফের সঙ্গে মিলিয়ে যাচ্ছে জৈব ও বিভিন্ন রাসায়নিক বর্জ্য। তাই হিমালয়জয়ের ৬০তম বছরে পর্বতারোহণের ওপর নতুন করে কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপের পরিকল্পনা করছে নেপাল সরকার। হিমালয় পবর্তঘেরা এই দেশটি চালাচ্ছে বিশেষ পরিষ্কার অভিযান। সেই সঙ্গে তাদের পরিকল্পনায় আছে, হিমালয়শৃঙ্গের সবচেয়ে কঠিন অংশ হিলারি স্টেপে মই বসানোর। কিন্তু রোমাঞ্চপ্রেমীরা বাধ সেধেছেন এ পরিকল্পনায়। কারণ হিলারি স্টেপে মই বসালে পর্বতারোহণের সবচেয়ে কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং অংশটিরই অবসান ঘটবে। তাই সেখানে মই বসানোর পরিকল্পনায় আপাতত দাঁড়ি পড়েছে। ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত হিমালয়শৃঙ্গের অভিমুখে বছরের নির্দিষ্ট সময় একটি রুটে একটি দলই যাত্রা করতে পারত। ওই সময় ওই রুটে একের অধিক দলকে পারমিট দিত না নেপাল সরকার। তাই সে সময় বর্তমানের চেয়ে তুলনামূলক কম চাপ পড়ত। ধারণা করা হচ্ছে, হিমালয়ের আগের সেই রূপ ফিরিয়ে আনতে প্রস্তাবিত পরিকল্পনার মধ্যে পুরনো আইনটি নতুন করে চালুর কথা রয়েছে। তবে এ বছর থেকে এভারেস্টচূড়ায় ওঠার জন্য সবচেয়ে কঠোর হচ্ছে যে আইনটি, তা হলো প্রশিক্ষণের অংশ। পর্বতারোহণের জন্য প্রশিক্ষিত পর্বতারোহীদের ব্যাপারে আরো কঠোর হচ্ছে নেপাল সরকার। কারণ যে হারে বাড়ছে এভারেস্টজয়ীর সংখ্যা, সে হারেই এ পর্বতের বুকে মৃতের সংখ্যাও বেড়েই চলেছে। এ বছর এরই মধ্যে হিমালয় অভিমুখে যাত্রা করেছেন ৫০০ পর্বতারোহী। আর হিমালয়ের বুকে এরই মধ্যে মারা পড়েছেন ১৬ জন। সর্বশেষ মৃত্যুর খবরটি পাওয়া যায় গত শুক্রবার। ৫৭ বছরের এক জাপানি নারী এবং ৫০ বছরের এক স্প্যানিশ পর্বতারোহী নিখোঁজ হন সেদিন। এর আগে বাংলাদেশের তরুণ নির্মাতা সজল খালেদের মৃত্যু নিয়েও বিশ্বমিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে উদ্বেগ। তখন থেকেই শুরু হয় আলোচনা। ঠিক করা হয়, এভারেস্টে ওঠার জন্য পর্বতারোহীদের আরো কঠোর প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। আসলে এভারেস্টের সঙ্গে দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর বিষয় দুটি কখনই সীমার মধ্যে ছিল না। প্রতি বছরই এভারেস্ট জয় করতে গিয়ে অসংখ্য মানুষ মারা পড়েন বরফে ঢাকা এ পর্বতে। ১৯৫৩ থেকে ২০১১ পর্যন্ত ৫ হাজার ৬৪৪ জন উঠেছেন হিমালয়ে। আর এ পর্বত অভিযানে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন ২১০ জন। মৃত্যুর হারটা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় ২০০৭ সালে (ওই বছর অবশ্য পর্বতারোহীর সংখ্যাও বেশি ছিল, ৬৩৩ জন) পর্বতারোহীরা জানান, বেশির ভাগ সময়ই হিমালয় জয় করে ফেরার পথেই মৃত্যুর ঘটনাটা ঘটে থাকে। অক্সিজেনের অভাবে এবং ক্লান্ত হয়ে পড়ায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন পর্বতারোহীরা। আর খারাপ মৌসুমের শিকার হলে তো বেঁচে যাওয়াটা অলৌকিক ঘটনাই বলা যায়। তবে পর্বতে ওঠার আগে যেমন কৌশলটা ভালোভাবে রপ্ত করে নেয়া জরুরি, তেমনি জেনে নেয়া প্রয়োজন পাহাড়ের বুকে ঘটে যাওয়া নির্মম ঘটনাগুলোও। ১৯৯৬ সালে ৩৬ ঘণ্টার ব্যবধানে আট পর্বতারোহীর মৃত্যুকে এ-যাবত্ কালের সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা বলে বিবেচনা করা হয়। তবে মৃত্যুঝুঁকি যতই থাকুক না কেন, পাহাড়প্রেমীদের কাছে এ বাধা তুচ্ছ। ২৯ হাজার ২৯ ফুট উঁচু পর্বতজয়ের জন্য তারা যেকোনো মূল্যই দিতে রাজি। এভারেস্টজয়ের জন্য খরচ বর্তমানে ১০ হাজার থেকে ১ লাখ ডলার পর্যন্তও ছুঁয়ে যায়। বেশির ভাগ সময়ই পর্বতারোহীদের স্পন্সর করে থাকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশেও পর্বতারোহীদের অভিযানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান স্পন্সর করে থাকে। বাংলাদেশের পর্বতজয়ের ইতিহাস খুব বেশি পুরনো নয়। হিমালয়ের কাছাকাছি দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাঙালির কাছে এর চূড়া স্পর্শ করাটা ছিল রীতিমতো স্বপ্নের মতো। ২০০৪ সাল থেকে সেই স্বপ্নকে ছোঁয়ার প্রত্যয় নিয়ে বাংলাদেশীরা পর্বত অভিযান শুরু করেন। দীর্ঘসময়ের প্রস্তুতি ও অনুশীলনের পর প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে ২০১০ সালের ২৪ মে মুসা ইব্রাহীম হিমালয়ের সর্বোচ্চ চূড়া স্পর্শ করেন। হঠাত্ করেই এভারেস্টজয় বিষয়টি এমন নয়। এর জন্য শারীরিক সামর্থ্যের পাশাপাশি প্রয়োজন নিয়মিত মাউন্টারিং। মুসা প্রথমে দার্জিলিংয়ে পর্বতারোহণের ওপর দুই মাসের ট্রেনিংয়ে অংশ নিয়েছেন। পাহাড়জয়ের জন্য অক্লান্ত অনুশীলন করেছেন ছয়-সাত বছর। ছোট ছোট পাহাড় ডিঙিয়ে সর্বোচ্চ চূড়ায় ওঠার মনোবল তৈরি করেছেন। এভারেস্টে ওঠার আগে তিনি নেপালের তৃতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ অন্নপূর্ণা ৪-এর চূড়ায় অর্থাত্ ২৪ হাজার ৬৮৮ ফুট উচ্চতায় ওঠেন। এরপর ২০১০ সালের ১০ এপ্রিল শুরু হয় এভারেস্ট অভিমুখে তার মূল অভিযান। তিনি ছয়বার এভারেস্টজয়ের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শেরপা গাইড সোম তামাংসহ ২৬ জনের অভিযাত্রী দলের একজন হিসেবে হিমালয় অভিযানে অংশ নেন এবং সফল হন। এরপর মুসা ইব্রাহীমের পথ ধরে দ্বিতীয় বাংলাদেশী এম এ মুহিত ২০১১ সালের ২১ মে জয় করেন হিমালয়। এর পরের বছরই অর্থাত্ ২০১২ সালের ১৯ মে নেপালের স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৯টায় হিমালয়ে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ান নিশাত মজুমদার। বাঙালি পুরুষরা যেখানে পাহাড় ট্র্যাকিংয়ে হিমশিম খান, সেখানে বাংলাদেশী নারী হিসেবে নিশাতের এভারেস্টজয় রীতিমতো আশ্চর্যের। তিনি প্রথম বাঙালি ও বাংলাদেশী নারী এবং তৃতীয় বাংলাদেশী হিসেবে হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গজয়ের ইতিহাসে নিজের নাম লেখান। বাংলাদেশের মেয়ে নিশাতের এ অভিযানের কৃতিত্ব বিশ্বের অন্য দশটা দেশের পর্বতারোহীদের চেয়ে ভিন্নতর। বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থা, ভৌগোলিক অবস্থান বিশেষ করে সমতল ভূমির একজন মানুষ হয়েও বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতচূড়ায় আরোহণ করার মতো সাফল্য সঙ্গত কারণেই অন্যদের থেকে তাকে আলাদা করে মূল্যায়নের দাবি রাখে। নিশাতের হিমালয়জয়ের মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে বাংলাদেশী আরেক নারী ওয়াসিফা নাজরীন স্পর্শ করেন এভারেস্টের চূড়া। এ বছর পঞ্চম বাংলাদেশী হিসেবে এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছেন পর্বতারোহী সজল খালেদ। কিন্তু হিমালয় জয় করে ফেরার পথে প্রাণ হারান তিনি। হিমালয়ে মৃত্যুর হাতছানি অভিযান শুরুর সময় থেকেই পর্বতারোহীদের ভাবায়। ১৯২৪ সালে অভিযাত্রী জর্জ ম্যালোরি ও অ্যান্ড্রু আরভিনের এভারেস্ট অভিযান এখনো এ সময়ের অভিযাত্রীদের অত্যাবশ্যকীয় পাঠ্য। সে বছর তাদের হিমালয় অভিমুখে যাত্রা এবং হারিয়ে যাওয়া— এখনো ঘোলা করে রেখেছে হিমালয়জয়ের ইতিহাসকে। ১৯২৪ সালে হারিয়ে যাওয়া জর্জ ম্যালোরিকে খুঁজে পাওয়া যায় ৭৫ বছর পর নিথর দেহে হিমালয়ের ২৬ হাজার ৭০০ ফুট উঁচুতে। এরপর হিমালয়জয়ের ঘোলা ইতিহাস যেন আরো ঘোলাটে হয়ে যায়। অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে শুরু করে, তবে কি ১৯৫৩ সালে এডমন্ড হিলারি ও তেনজিং নোরগের পর্বতজয়ের আগেই ২৯ হাজার ২০ ফুট উঁচু থেকে ম্যালোরি দেখেছিলেন পৃথিবীটাকে? সে ইতিহাস ঘোলাটেই। কিন্তু এডমন্ড-তেনজিংয়ের পর্বতজয় নিয়ে কারোরই কোনো শঙ্কা নেই। এজন্যই গেল সপ্তাহেই ধুমধাম করে পালন করা হলো এভারেস্টজয়ের হীরকজয়ন্তী। নেপালে তো আছেই, ব্রিটেনেও রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সিংহাসনে আরোহণের হীরকজয়ন্তীর সঙ্গে এ উপলক্ষকেও স্মরণীয় করে রাখা হলো এ বছর। লন্ডনের রয়্যাল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটি গেল বুধবার এডমন্ড হিলারির ছেলে পিটার হিলারি এবং তেনজিং নোরগের ছেলে জামলিং নোরগেকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করে। ওই অনুষ্ঠানে দুই কিংবদন্তি পর্বতারোহীর স্মৃতিচারণ করেন তাদের সন্তানরা। তারা জানান, ৬০ বছর আগে হিমালয়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে কীভাবে হিলারি হাত মেলানোর জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তেনজিংয়ের দিকে আর তেনজিং কীভাবে জড়িয়ে ধরেছিলেন হিলারিকে।

No comments