Header Ads

test

শিক্ষার মান কি নামতেই থাকবে?


বরাবরের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ইউনিট স্নাতক পর্যায়ে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ফল প্রকাশ করতে শুরু করেছে। অন্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও তা–ই করবে। ভর্তির ব্যবস্থা নেবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও স্নাতক পর্যায়ের কলেজগুলোও। এসব ভর্তি পরীক্ষা হয় উচ্চমাধ্যমিক স্তরে অর্জিত জ্ঞান যাচাই করতে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে প্রাপ্ত গ্রেড পয়েন্ট অ্যাভারেজের (জিপিএ) মানও বিবেচনায় নেওয়া হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষার ফল সম্প্রতি প্রকাশিত হলো। ২৫ হাজার ৯৫৮ জন পরীক্ষা দিয়ে পাস করল ২ হাজার ৮৫০ জন, অর্থাৎ শতকরা ১০ দশমিক ৯৮ ভাগ। অবিশ্বাস্য রকমের ফল বিপর্যয় বলা যেতে পারে। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলা চলে, অন্য ইউনিটেও ফলের তেমন হেরফের হবে না। কয়েক বছর ধরে তা–ই ঘটে চলছে। এটা ঠিক, যারা পাস করেছে তাদেরও অনেকে এখানে ভর্তি হতে পারবে না। এই ইউনিটে আসনসংখ্যা ১ হাজার ২৫০। মেধা ও কোটা অনুসারে ভর্তি হবে। বাকিদের যেতে হবে অন্য কোথাও। যাহোক মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে জিপিএ–৫ কিংবা ৪–এর এত জৌলুশ নিয়ে যারা সে স্তরগুলো অতিক্রম করে, তারা এই পরীক্ষাটা পাস করবে না কেন? প্রশ্নের মান তো উচ্চমাধ্যমিক স্তরের। তাহলে ধরে নিতে হবে সে স্তরগুলোর ফলাফলে চমক যতই থাকুক, শিক্ষার মানে আশঙ্কাজনক ঘাটতি রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ ইউনিটে ম্যানেজমেন্ট, অ্যাকাউন্টিং, মার্কেটিং, ফিন্যান্স, ব্যাংকিংসহ ৯টি বিভাগ রয়েছে। সেগুলোর ভর্তি পরীক্ষা হয় ১ ঘণ্টায় ১০০টি প্রশ্নের ওপর। এমসিকিউ পদ্ধতিতে বাংলা, ইংরেজি, অ্যাকাউন্টিং, ব্যবসায় নীতি ও প্রয়োগ, মার্কেটিং/ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং—এই পাঁচ বিষয়ে সমানভাগে ২০টি করে প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। প্রতিটি প্রশ্নের সঠিক উত্তরের জন্য মান ১.২, অর্থাৎ ১২০ নম্বরের পরীক্ষা। পাস করতে পেতে হয় ৪৮। তবে ইংরেজিতে ১০ পাওয়া বাধ্যতামূলক। এ পর্যায়ে পড়াশোনা করতে ইংরেজি ভাষার ওপর কিছুটা দখল থাকতে হয়। আর মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকেও ইংরেজি পড়ানো হয়। তাই এটুকু নম্বর পাওয়া কঠিন বলা যাবে না। এই পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের সঙ্গে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের ফলের ভিত্তিতে ৮০ নম্বর যোগ করে সম্মিলিত মেধাতালিকা তৈরি হয়।
জিপিএ পদ্ধতি চালুর আগে তখন প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগ ছিল। ছিল লেটার ও স্টার মার্ক। তিন দশক আগেও আগাগোড়া দ্বিতীয় বিভাগ বা শ্রেণি পাওয়া শিক্ষার্থীরা ভালো ছাত্র বলেই পরিচিত ছিল। তারা সর্বত্র না হলেও ভর্তি হতে পারত অনেক বিষয়ে। কর্মজীবনে সফলই হতো। আর গোটা দুই প্রথম বিভাগ পাওয়া ছাত্ররা তো সাধারণত কোথাও ঠেকত না। নতুন গ্রেডিং পদ্ধতি দোষণীয় কিছু নয়। এতেও মান যাচাই করা যায়। বেশ কয়েক বছর যেনতেনভাবে তা করা হচ্ছে বলে জোরালো অভিযোগ রয়েছে। শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকের মতে, যাদের দ্বিতীয় বিভাগে পাস করা দুষ্কর ছিল, তারাও পরীক্ষা ও ফলাফল যাচাই পদ্ধতির সুযোগে উচ্চতর গ্রেড পেয়ে যাচ্ছে। এতে ক্ষতি হচ্ছে প্রকৃত ভালো ছাত্রদের। মুড়ি–মুড়কি এক করে ফেলা হচ্ছে। শতকরা ৮০ নম্বর পেলে এ+। আর ১০০ পেলেও তাই। এ দুটো নম্বর কিন্তু অভিন্ন বা খুব কাছাকাছি নয়। এটা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি গ্রেডিং পদ্ধতিতে। প্রথম বিভাগ পাওয়াই আগে সোনার হরিণ ছিল। এখন জিপিএ–৪ পেলে বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে যায়। অন্যদিকে জিপিএ–৫ পাওয়া শিক্ষার্থীরাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরনের একটি ভর্তি পরীক্ষায় পাস নম্বরটুকু পর্যন্ত পায় না। এটা ঠিক, সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে না। আগেও পারত না। এখনো বাকিরা একে একে অন্যান্য পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় বেছে নেবে। আর স্নাতক পর্যায়ে পড়ার মতো কলেজ তো রয়েছে অনেক। আর গুটি কয়েক কলেজ কিন্তু কোনো কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে মানের দিক দিয়ে পাল্লা দিতে পারে। আছে দু–তিনটি ভালো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। বাকিগুলোয় লেখাপড়া হোক বা না হোক ভালো গ্রেডের সনদের নিশ্চয়তা আছে। এগুলো থেকে পাস করে কোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে এদের কেউ ভালো কিছু করছে এমন দেখা যায় না।
আলোচিত ভর্তি পরীক্ষার ফল আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, খুঁটির গোড়ায় মাটি নেই। এটা বেশ কয়েক বছর আগে থেকে পরিষ্কার হয়ে উঠছিল। দেশের সচেতন সমাজ এমনকি শিক্ষকেরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। পরীক্ষাব্যবস্থার কল্যাণে সুন্দর ফল করে যেনতেনভাবে উচ্চমাধ্যমিক পাড়ি দেওয়া যায়। এই জনশক্তি কিন্তু আমাদের জনসম্পদে যুক্ত হলেও দক্ষতার ব্যাপক ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। এটা সবাই বোঝেন। কিন্তু যা হওয়ার তাই হচ্ছে। ক্রমে ক্রমে প্রসারিত হচ্ছে দুর্বল ভিত। ভালো ছাত্রছাত্রী আমাদের অনেক আছে। তবে এই বিশ্বায়নের যুগে এদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে আমরা নিয়তই হারাচ্ছি। পাড়ি দিচ্ছে ভিনদেশে। সমৃদ্ধ হচ্ছে নিজেরা। অবদান রাখছে সে দেশ ও সমাজে। আমাদের কিন্তু ক্রমবর্ধমান চাহিদার তুলনায় মেধাবী জনশক্তির ঘাটতিই থাকছে। নচেৎ এত বিদেশি নাগরিক আমাদের শিল্পকারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্যে কাজ করে কীভাবে? দেশের ছেলেমেয়েদের পেলে উদ্যোক্তারা অকারণে বেশি ব্যয় করে বিদেশিদের নিতেন, এমনটা মনে হয় না।
বলা হতে পারে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নের মান কঠিন হয়েছে। হতে পারে। তাদের তো এ ইউনিটে ধারণক্ষমতাই ১ হাজার ২৫০। তবে তারা কাউকে পাস বা ফেল করায় না। ২ হাজার ৮৫০ জন পাস করলেও যা, ১২ হাজার পাস করলেও তা–ই হতো। এই পরীক্ষাটিতে অন্তত অর্ধেক পরীক্ষার্থী পাস নম্বর পাওয়া সংগত ছিল। আসন সীমিত। ভর্তি সবাই হবে না। সবই ঠিক। আরও অনেক ইউনিট আছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানেও স্থান হবে অনেকের। আর অন্যত্র ভর্তির সুযোগ তো আলোচনা করাই হয়েছে। তবে এ ধরনের ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে আমরা হালের শিক্ষার মান সম্পর্কে একটি ধারণা পেয়ে যাচ্ছি। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় বেশিসংখ্যক ছাত্রছাত্রী পাস এবং ভালো গ্রেড শিক্ষার মানের নির্দেশিকা হওয়ার কথা। তবে এ পাস আর গ্রেড যদি যথার্থ না হয়, তবেই এ ধরনের ফল বিপর্যয় ঘটতে পারে। সেটাই হচ্ছে। এদের বিরাট একটি অংশ কোনো নিম্নমানের কলেজ বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক এমনকি স্নাতকোত্তর সনদও পাবে। তবে ঘাটতিটা কাটাতে পারবে না কোনো অবস্থাতেই। ভারী হতে থাকবে শিক্ষিত বেকারের তালিকা।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাটির মূল ধারাও বহুধাবিভক্ত। এমনিতেই সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কিছুসংখ্যক খুবই ভালো মানের বলা যায়। বাকি সব চলতি মান কিংবা তারও নিচে। আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার মানও নিম্নমুখী বলে অভিযোগ রয়েছে। হালে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যবস্থা হলো। তবে তাদের শিক্ষাব্যবস্থায়ও রয়েছে বড় ধরনের অসম্পূর্ণতা। সরকারের কোনো পৃষ্ঠপোষকতা না নিয়ে শত শত ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক সমপর্যায়ের ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেল সনদ পাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। একটু সংগতিসম্পন্ন ঘরের ছেলেমেয়েদের সেখানে পড়ানো এখন একটি জনপ্রিয় সংস্কৃতি। শিক্ষার ব্যয় অনেক বেশি হলেও অসংকোচে টাকা ঢালছেন অভিভাবকেরা। এগুলো থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা পরে বিরল ব্যতিক্রম ব্যতীত আমাদের মূলধারায় একীভূত হতে খুব স্বস্তিবোধ করে না। এত বৈপরীত্যের মাঝেও বলতে হয়, এই দেশ ভালোভাবে চালাতে হবে এখানকার মানুষদেরই। আজকে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে যাচ্ছে, তারাই পাঁচ–ছয় বছর পরে দেশের চালিকাশক্তির অংশ হয়ে যাবে। তাদের মেধার ঘাটতি আমাদের শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা দূরীভূত হোক, তা আমরা জোরদারভাবে চাই। আশা রইল হবে। 
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
majumderali1950@gmail.com
 
খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না: প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ বিতর্ক

খাচ্ছে কিন্তু গিলছে না: প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ বিতর্ক

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান যেভাবে বাড়বে

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান যেভাবে বাড়বে

ব্যাংক ব্যবস্থায় রাজনীতির প্রভাব

ব্যাংক ব্যবস্থায় রাজনীতির প্রভাব

সুবিধা শুধু ফোন কোম্পানিগুলোর

সুবিধা শুধু ফোন কোম্পানিগুলোর

মন্তব্য ( ৫ )

No comments