যে কারণে জামায়াত শক্তিশালী
আপডেট: ০১:১৬, ডিসেম্বর ২১, ২০১৩
| প্রিন্ট সংস্করণ
|
তিন দশকের ধারাবাহিকতায় সাতক্ষীরায় জামায়াতে ইসলামী সাংগঠনিকভাবে
শক্তিশালী ভিত গড়ে তুলেছে। তারা এলাকায় বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে
তুলেছে। অর্থলগ্নিকারী সংস্থাগুলো থেকে ক্ষুদ্রঋণ পাইয়ে দিয়ে মাঠপর্যায়ে
কর্মী সৃষ্টি ও তাঁদের আর্থিকভাবে শক্তিশালী করেছে।
এর বাইরে আছে ঐতিহাসিক কারণও। জেলার রাজনীতিসচেতন ব্যক্তিরা বিশেষভাবে সাতচল্লিশের ভারত বিভক্তির কথা উল্লেখ করে বলেন, তখনো এ জেলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল হিন্দুরা। তারা এলাকা ছেড়ে যেতে শুরু করলে তাদের জায়গায় এসে বসবাস শুরু করে অভিবাসী মুসলমানরা। ঐতিহ্যগতভাবে এই অভিবাসীদের মধ্যে প্রবল ভারতবিদ্বেষ রয়েছে।
সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এখানে সব কয়টি আসন পেলেও আওয়ামী লীগের বিরোধীপক্ষ নেহাত কম ভোট পায়নি। স্থানীয় একাধিক রাজনীতিক জানান, পরিস্থিতি একেবারে বদলে যায় পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিকশিত হতে থাকে মৌলবাদী রাজনীতি।
১৯৭৯ সালের (জিয়াউর রহমানের আমলে) জাতীয় নির্বাচনে সাতক্ষীরার তিনটি আসনে মুসলিম লীগের প্রার্থী জয়লাভ করেন। ওই নির্বাচনে সাতক্ষীরা সদর আসনে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান বিরোধিতাকারী খান এ সবুর জয়লাভ করেন।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) জেলা শাখার সংগঠক আজাদ হোসেন বলেন, জাতীয় রাজনীতিতে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে আসা মুসলিম লীগের বিপর্যয়ের ওপরই নিজেদের ভিত গড়তে শুরু করে জামায়াত। প্রথমে মুসলিম লীগ সমর্থকদের দলে টানে তারা। তাদের দিয়েই জেলাব্যাপী শক্তিশালী একটি ঘাঁটি তৈরি করতে সক্ষম হয় জামায়াত। তখন থেকেই জামায়াতের পৃষ্ঠপোষকতায় জেলায় একের পর এক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। বর্তমানে এ জেলা ২৭৪টি মাদ্রাসা রয়েছে।
১৯৮৬ সালের নির্বাচনে সাতক্ষীরা-১ (তালা-কলারোয়া) আসনে জামায়াতের আনসার আলী এবং সাতক্ষীরা-২ (সদর) আসনে কাজী শামছুর রহমান নির্বাচিত হন। কাজী শামছুর রহমান একাত্তরে সাতক্ষীরায় শান্তি কমিটির সেক্রেটারি ছিলেন। পরে ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনেও জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে তিনি সাতক্ষীরা-২ (সদর) আসন থেকে নির্বাচিত হন।
জেলা ১৪ দলের সমন্বয়কারী ও ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক মুস্তফা লুৎফুল্লাহ বলেন, ১৯৮৬ সালের নির্বাচনেই প্রথমবারের মতো সাতক্ষীরায় জামায়াতের ব্যাপক উত্থানটি স্পষ্ট হয়। এর আগে থেকেই সাতক্ষীরায় জামায়াত তাদের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। আর্থিকভাবে সহযোগিতা দিয়ে খেটে খাওয়া মানুষকে দলে টানে। তবে ওই নির্বাচনের পর বিভিন্ন অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান থেকে ক্ষুদ্রঋণ পাইয়ে দিয়ে মাঠপর্যায়ের জামায়াতের নেতা-কর্মীদের অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করে তুলেছে তারা।
১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে সাতক্ষীরার পাঁচটি আসনের মধ্যে চারটি আসনেই জামায়াতের প্রার্থী জয়লাভ করেন। ১৯৯৬ সালে একমাত্র সাতক্ষীরা-২ (সদর) আসনে কাজী শামছুর রহমান নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে আবার সাতক্ষীরা ২, ৩ ও ৫—এই তিনটি আসন পায় জামায়াত।
২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাতক্ষীরায় পাঁচটি আসনের বদলে চারটি আসন করা হয়। এ নির্বাচনে জামায়াত কোনো আসন পায়নি। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি দুটি করে আসনে জিতেছিল।
তবে তারা নির্বাচিত হয়ে উপদলীয় কোন্দল ও স্বার্থসিদ্ধিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে বলেই জামায়াত শক্তিশালী হয়েছে বলে মনে করেন জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি আবুল হোসেন। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগে যেমন অভ্যন্তরীণ কোন্দল রয়েছে, তেমনি যোজন দূরত্ব রয়েছে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির মধ্যে। প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগ যখন জিতে তখন সবাইকে পর করে দেয়।’ তিনি আত্মসমালোচনা করে বলেন, ‘আমরা বামপন্থীরাও অনেকাংশে ব্যর্থ হয়েছি।’
সাতক্ষীরা-৩ (আশাশুনি, দেবহাটা ও কালীগঞ্জের একাংশ) আসন থেকে নির্বাচনে আট হাজার ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হন সদ্য সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক। এর আগে ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি ওই আসন থেকে প্রথমবার নির্বাচন করে চার হাজার ভোটের জন্য হেরে যান। মূলত ওই নির্বাচনের আগেই তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। তবে রুহুল হকের আত্মীয়স্বজনের বেশির ভাগই জামায়াত, না হয় বিএনপি করেন বলে এলাকায় প্রচারণা রয়েছে।
গেল নির্বাচনে জামায়াতের প্রার্থীকে হারিয়ে রুহুল হক জয়ী হলেও তাঁর নিজ গ্রামের কেন্দ্রে দুবারই পরাজিত হয়েছেন। কিন্তু মন্ত্রী হওয়ার পর তিনি সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) হিসেবে মো. মোশায়েত আলী নামের যে লোকটিকে নিয়োগ দেন, তিনি ছাত্রজীবনে কালীগঞ্জ কলেজ ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। আর তাঁর একান্ত সচিব (পিএস) আবু মাসুদ জামায়াতের লোক বলে এলাকায় প্রচারণা রয়েছে। আবু মাসুদ বাড়ি মন্ত্রীর বাড়ির এলাকা নলতায়।
এলাকায় আওয়ামী লীগের পরস্পরবিরোধী দুটি উপদলের মধ্যে কোন্দল জিইয়ে রাখা ও আত্মীয়স্বজনদের ব্যাপক সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে রুহুল হকের ব্যাপারে। অবশ্য তিনি উপদলীয় কোন্দল মেটানোর ব্যাপারে বারবার উদ্যোগ নিয়েছেন বলে দাবি করেছেন প্রথম আলোর কাছে। তিনি বলেন, তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগটিও সঠিক নয়।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানও এলাকায় থাকেন না। তিনি সাতক্ষীরা-১ (তালা-কলারোয়া) আসনের সাংসদ। এবারও এ আসন থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। বর্তমানে ঢাকায় অবস্থানকারী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুজিবুর দুই দিন আগে প্রথম আলোর কাছে সহসাই এলাকায় আসবেন বলে জানালেও এখন পর্যন্ত তাঁকে দেখা যায়নি।
মুঠোফোনে মুজিবুর রহমান কাছে সাতক্ষীরায় জামায়াতের উত্থানের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, ঐতিহাসিকভাবে এ এলাকায় মৌলবাদীরা প্রশ্রয় পেয়ে আসছে। দেশ বিভাগের পর যারা বিনিময় করে ভারত ছেড়ে তৎকালীন পাকিস্তানে এসেছিল, তাদের অনেকেই এখন পর্যন্ত বাংলাদেশকেই মেনে নিতে পারেনি। তাদের নিয়েই জামায়াতের রাজনীতি। তবে তিনি মনে করেন, এত কিছুর পরেও এবার জামায়াত এ জেলায় যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, তার সুযোগ তৈরি হয়েছে আওয়ামী লীগের অনৈক্য সৃষ্টির কারণে। তিনি আরও বলেন, এ অনৈক্যের কারণেই সংসদ নির্বাচনে সব কয়টি আসনে বিজয়ের পর স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ভালো করতে পারেনি।
বর্তমানে জেলার সাতটি উপজেলার ৭৮টি ইউনিয়নের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬টি, বিএনপি ৩০টি, জামায়াত ২৭টি এবং জাতীয় পার্টি পাঁচটিতে নির্বাচিত হয়। এ ছাড়া সাতক্ষীরা ও কলারোয়া পৌরসভা দুটিতে বিএনপির সমর্থকেরা মেয়র নির্বাচিত হন।
সদর উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের মধ্যে আওয়ামী লীগের একজন এবং বিএনপি-জামায়াতের ১৩ জন চেয়ারম্যান রয়েছেন। তালায় ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে দুটিতে আওয়ামী লীগ, বাকি ১০টিতে জামায়াত-বিএনপির সমর্থকেরা চেয়ারম্যান। কলারোয়ার ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে আওয়ামী লীগের তিনটি, বাকি নয়টিতে জামায়াত-বিএনপির সমর্থকেরা চেয়ারম্যান। দেবহাটায় পাঁচটির মধ্যে আওয়ামী লীগের দুজন ও জামায়াতের তিনজন চেয়ারম্যান। কালীগঞ্জে ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে জামায়াত-বিএনপির নয়জন এবং আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির তিনজন চেয়ারম্যান। শ্যামনগর উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে ১০ জন জামায়াত-বিএনপি ও দুজন আওয়ামী লীগের সমর্থক চেয়ারম্যান রয়েছেন। আশাশুনিতে ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে আটটিতে আওয়ামী লীগ এবং বাকি চারটিতে জামায়াত-বিএনপির চেয়ারম্যান।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ফিরোজ আহমেদ বলেন, এর আগে বিএনপি-জামায়াত যখন ক্ষমতায় ছিল তখন মাঠপর্যায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির চিত্রটা ছিল উল্টো। অধিকাংশ চেয়ারম্যান ছিলেন আওয়ামী লীগ-সমর্থিত।
স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, জনপ্রতিনিধিরা উদ্যোগী হলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো সহজ হয়। কিন্তু এখন বেশির ভাগ জনপ্রতিনিধি ১৮ দল-সমর্থিত হওয়ায় তাঁরা পরিস্থিতির উন্নয়নের ব্যাপারে ভূমিকা রাখার পরিবর্তে উসকানি দিয়ে অবনতি ঘটাচ্ছেন।
এর বাইরে আছে ঐতিহাসিক কারণও। জেলার রাজনীতিসচেতন ব্যক্তিরা বিশেষভাবে সাতচল্লিশের ভারত বিভক্তির কথা উল্লেখ করে বলেন, তখনো এ জেলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল হিন্দুরা। তারা এলাকা ছেড়ে যেতে শুরু করলে তাদের জায়গায় এসে বসবাস শুরু করে অভিবাসী মুসলমানরা। ঐতিহ্যগতভাবে এই অভিবাসীদের মধ্যে প্রবল ভারতবিদ্বেষ রয়েছে।
সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এখানে সব কয়টি আসন পেলেও আওয়ামী লীগের বিরোধীপক্ষ নেহাত কম ভোট পায়নি। স্থানীয় একাধিক রাজনীতিক জানান, পরিস্থিতি একেবারে বদলে যায় পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিকশিত হতে থাকে মৌলবাদী রাজনীতি।
১৯৭৯ সালের (জিয়াউর রহমানের আমলে) জাতীয় নির্বাচনে সাতক্ষীরার তিনটি আসনে মুসলিম লীগের প্রার্থী জয়লাভ করেন। ওই নির্বাচনে সাতক্ষীরা সদর আসনে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান বিরোধিতাকারী খান এ সবুর জয়লাভ করেন।
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) জেলা শাখার সংগঠক আজাদ হোসেন বলেন, জাতীয় রাজনীতিতে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে আসা মুসলিম লীগের বিপর্যয়ের ওপরই নিজেদের ভিত গড়তে শুরু করে জামায়াত। প্রথমে মুসলিম লীগ সমর্থকদের দলে টানে তারা। তাদের দিয়েই জেলাব্যাপী শক্তিশালী একটি ঘাঁটি তৈরি করতে সক্ষম হয় জামায়াত। তখন থেকেই জামায়াতের পৃষ্ঠপোষকতায় জেলায় একের পর এক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। বর্তমানে এ জেলা ২৭৪টি মাদ্রাসা রয়েছে।
১৯৮৬ সালের নির্বাচনে সাতক্ষীরা-১ (তালা-কলারোয়া) আসনে জামায়াতের আনসার আলী এবং সাতক্ষীরা-২ (সদর) আসনে কাজী শামছুর রহমান নির্বাচিত হন। কাজী শামছুর রহমান একাত্তরে সাতক্ষীরায় শান্তি কমিটির সেক্রেটারি ছিলেন। পরে ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনেও জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে তিনি সাতক্ষীরা-২ (সদর) আসন থেকে নির্বাচিত হন।
জেলা ১৪ দলের সমন্বয়কারী ও ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক মুস্তফা লুৎফুল্লাহ বলেন, ১৯৮৬ সালের নির্বাচনেই প্রথমবারের মতো সাতক্ষীরায় জামায়াতের ব্যাপক উত্থানটি স্পষ্ট হয়। এর আগে থেকেই সাতক্ষীরায় জামায়াত তাদের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। আর্থিকভাবে সহযোগিতা দিয়ে খেটে খাওয়া মানুষকে দলে টানে। তবে ওই নির্বাচনের পর বিভিন্ন অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান থেকে ক্ষুদ্রঋণ পাইয়ে দিয়ে মাঠপর্যায়ের জামায়াতের নেতা-কর্মীদের অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করে তুলেছে তারা।
১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে সাতক্ষীরার পাঁচটি আসনের মধ্যে চারটি আসনেই জামায়াতের প্রার্থী জয়লাভ করেন। ১৯৯৬ সালে একমাত্র সাতক্ষীরা-২ (সদর) আসনে কাজী শামছুর রহমান নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে আবার সাতক্ষীরা ২, ৩ ও ৫—এই তিনটি আসন পায় জামায়াত।
২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সাতক্ষীরায় পাঁচটি আসনের বদলে চারটি আসন করা হয়। এ নির্বাচনে জামায়াত কোনো আসন পায়নি। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি দুটি করে আসনে জিতেছিল।
তবে তারা নির্বাচিত হয়ে উপদলীয় কোন্দল ও স্বার্থসিদ্ধিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে বলেই জামায়াত শক্তিশালী হয়েছে বলে মনে করেন জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি আবুল হোসেন। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগে যেমন অভ্যন্তরীণ কোন্দল রয়েছে, তেমনি যোজন দূরত্ব রয়েছে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির মধ্যে। প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগ যখন জিতে তখন সবাইকে পর করে দেয়।’ তিনি আত্মসমালোচনা করে বলেন, ‘আমরা বামপন্থীরাও অনেকাংশে ব্যর্থ হয়েছি।’
সাতক্ষীরা-৩ (আশাশুনি, দেবহাটা ও কালীগঞ্জের একাংশ) আসন থেকে নির্বাচনে আট হাজার ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হন সদ্য সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক। এর আগে ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি ওই আসন থেকে প্রথমবার নির্বাচন করে চার হাজার ভোটের জন্য হেরে যান। মূলত ওই নির্বাচনের আগেই তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। তবে রুহুল হকের আত্মীয়স্বজনের বেশির ভাগই জামায়াত, না হয় বিএনপি করেন বলে এলাকায় প্রচারণা রয়েছে।
গেল নির্বাচনে জামায়াতের প্রার্থীকে হারিয়ে রুহুল হক জয়ী হলেও তাঁর নিজ গ্রামের কেন্দ্রে দুবারই পরাজিত হয়েছেন। কিন্তু মন্ত্রী হওয়ার পর তিনি সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) হিসেবে মো. মোশায়েত আলী নামের যে লোকটিকে নিয়োগ দেন, তিনি ছাত্রজীবনে কালীগঞ্জ কলেজ ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। আর তাঁর একান্ত সচিব (পিএস) আবু মাসুদ জামায়াতের লোক বলে এলাকায় প্রচারণা রয়েছে। আবু মাসুদ বাড়ি মন্ত্রীর বাড়ির এলাকা নলতায়।
এলাকায় আওয়ামী লীগের পরস্পরবিরোধী দুটি উপদলের মধ্যে কোন্দল জিইয়ে রাখা ও আত্মীয়স্বজনদের ব্যাপক সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে রুহুল হকের ব্যাপারে। অবশ্য তিনি উপদলীয় কোন্দল মেটানোর ব্যাপারে বারবার উদ্যোগ নিয়েছেন বলে দাবি করেছেন প্রথম আলোর কাছে। তিনি বলেন, তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগটিও সঠিক নয়।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানও এলাকায় থাকেন না। তিনি সাতক্ষীরা-১ (তালা-কলারোয়া) আসনের সাংসদ। এবারও এ আসন থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। বর্তমানে ঢাকায় অবস্থানকারী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুজিবুর দুই দিন আগে প্রথম আলোর কাছে সহসাই এলাকায় আসবেন বলে জানালেও এখন পর্যন্ত তাঁকে দেখা যায়নি।
মুঠোফোনে মুজিবুর রহমান কাছে সাতক্ষীরায় জামায়াতের উত্থানের কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, ঐতিহাসিকভাবে এ এলাকায় মৌলবাদীরা প্রশ্রয় পেয়ে আসছে। দেশ বিভাগের পর যারা বিনিময় করে ভারত ছেড়ে তৎকালীন পাকিস্তানে এসেছিল, তাদের অনেকেই এখন পর্যন্ত বাংলাদেশকেই মেনে নিতে পারেনি। তাদের নিয়েই জামায়াতের রাজনীতি। তবে তিনি মনে করেন, এত কিছুর পরেও এবার জামায়াত এ জেলায় যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, তার সুযোগ তৈরি হয়েছে আওয়ামী লীগের অনৈক্য সৃষ্টির কারণে। তিনি আরও বলেন, এ অনৈক্যের কারণেই সংসদ নির্বাচনে সব কয়টি আসনে বিজয়ের পর স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ভালো করতে পারেনি।
বর্তমানে জেলার সাতটি উপজেলার ৭৮টি ইউনিয়নের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬টি, বিএনপি ৩০টি, জামায়াত ২৭টি এবং জাতীয় পার্টি পাঁচটিতে নির্বাচিত হয়। এ ছাড়া সাতক্ষীরা ও কলারোয়া পৌরসভা দুটিতে বিএনপির সমর্থকেরা মেয়র নির্বাচিত হন।
সদর উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের মধ্যে আওয়ামী লীগের একজন এবং বিএনপি-জামায়াতের ১৩ জন চেয়ারম্যান রয়েছেন। তালায় ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে দুটিতে আওয়ামী লীগ, বাকি ১০টিতে জামায়াত-বিএনপির সমর্থকেরা চেয়ারম্যান। কলারোয়ার ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে আওয়ামী লীগের তিনটি, বাকি নয়টিতে জামায়াত-বিএনপির সমর্থকেরা চেয়ারম্যান। দেবহাটায় পাঁচটির মধ্যে আওয়ামী লীগের দুজন ও জামায়াতের তিনজন চেয়ারম্যান। কালীগঞ্জে ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে জামায়াত-বিএনপির নয়জন এবং আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির তিনজন চেয়ারম্যান। শ্যামনগর উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে ১০ জন জামায়াত-বিএনপি ও দুজন আওয়ামী লীগের সমর্থক চেয়ারম্যান রয়েছেন। আশাশুনিতে ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে আটটিতে আওয়ামী লীগ এবং বাকি চারটিতে জামায়াত-বিএনপির চেয়ারম্যান।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ফিরোজ আহমেদ বলেন, এর আগে বিএনপি-জামায়াত যখন ক্ষমতায় ছিল তখন মাঠপর্যায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির চিত্রটা ছিল উল্টো। অধিকাংশ চেয়ারম্যান ছিলেন আওয়ামী লীগ-সমর্থিত।
স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, জনপ্রতিনিধিরা উদ্যোগী হলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো সহজ হয়। কিন্তু এখন বেশির ভাগ জনপ্রতিনিধি ১৮ দল-সমর্থিত হওয়ায় তাঁরা পরিস্থিতির উন্নয়নের ব্যাপারে ভূমিকা রাখার পরিবর্তে উসকানি দিয়ে অবনতি ঘটাচ্ছেন।
Post a Comment