জনগণের শঙ্কা কাটেনি
ইফতেখারুজ্জামান | আপডেট: ০০:০৪, ডিসেম্বর ২৬, ২০১৩ | প্রিন্ট সংস্করণ
৭৬
কার্টুন: তুলিগত মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া বিরোধী দলের নেতা ও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বক্তব্যটি নানা কারণে দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কয়েক দফা হরতাল-অবরোধের পর তিনি নতুন কী কর্মসূচি নেন, সে সম্পর্কে সবার কৌতূহল ছিল। শেষ পর্যন্ত তিনি হরতাল-অবরোধের মতো চরম কর্মসূচি দেননি, এ জন্য ধন্যবাদ পেতে পারেন।
কিন্তু খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলনে যেসব বক্তব্য বা প্রস্তাব দিয়েছেন, তাতে স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থার কথা বলা হলেও সংকট উত্তরণে দীর্ঘমেয়াদি কোনো দিকনির্দেশনা নেই। তিনি ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন না করার জন্য সরকারকে বলেছেন। এটি কেবল আহ্বান বা হুঁশিয়ারির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে ভালো হতো। একই সঙ্গে তিনি সেই নির্বাচন প্রতিহত করতে সবাইকে ঢাকায় আসার আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর ভাষায়, ‘ভোটাধিকার হরণকারী ও মানবতা লঙ্ঘনকারী সরকারের বিরুদ্ধে প্রাণক্ষয়ী লড়াইয়ে যাঁরা শরিক আছেন, এবং হচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে সমন্বয়, সমঝোতা ও ঐক্য গড়ে তুলুন।’
এর মাধ্যমে বিএনপি নেত্রী কি বোঝাতে চাইছেন যে ‘প্রাণক্ষয়ী’ আন্দোলনকারীদের মধ্যে আরও সমন্বয়, সমঝোতা ও ঐক্যের প্রয়োজন আছে? এখন সেই ‘প্রাণক্ষয়ী’ আন্দোলনকারীরা যদি আরও সংহত হন, তাহলে পরিস্থিতি কোন দিকে গড়াবে, বুঝতে অসুবিধা হয় না। জনগণের মধ্যে উৎকণ্ঠা আরও বাড়বে।
নির্বাচনের ব্যাপারে সমঝোতা না হওয়ার জন্য বিরোধী দলের নেতা সরকারের একগুঁয়েমি ও অনমনীয় মনোভাবকে দায়ী করেছেন। তাঁর এই অভিযোগের সঙ্গে আমরা দ্বিমত করছি না। কিন্তু সরকারের সেই একগুঁয়েমির বিরুদ্ধে বিরোধী দল আন্দোলনের নামে যে সহিংসতা ও নাশকতার ঘটনা ঘটাচ্ছে, তাও সমর্থনযোগ্য নয়।
প্রকৃতপক্ষে দুই পক্ষের অনমনীয় মনোভাবের কারণেই সবার অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশা অপূর্ণই থেকে গেল। এখন সরকার যে একতরফা নির্বাচন করতে যাচ্ছে, তা দেশে-বিদেশে সবার কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। ইতিমধ্যে অর্ধেকেরও বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়েছেন। যেহেতু এই নির্বাচনের প্রতি জনগণেরই আগ্রহ নেই, সেহেতু প্রতিহত করার নামে সংঘাতকে উসকে দেওয়ার কী প্রয়োজন?
নির্বাচন প্রতিহত করার আন্দোলনে কোনো অঘটন ঘটলে তার দায়ও তাদের ওপর এসে পড়বে। সরকারের পক্ষ থেকে বিরোধী দলের সভা-সমাবেশ বন্ধ করা যেমন গণতন্ত্র নয়, তেমনি সহিংস পথে নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণাও গণতন্ত্রের ভাষা নয়।
দ্বিতীয়ত, একজন যুদ্ধাপরাধীর রায় কার্যকর করার বিরুদ্ধে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে নেওয়া প্রস্তাব বিষয়ে খালেদা জিয়া মর্মাহত বলে যে মন্তব্য করেছেন, তা-ও জন-আকাঙ্ক্ষার তুলনায় অপ্রতুল বলে মনে হয়। জনগণ তাঁর কাছে এ ব্যাপারে আরও শক্ত অবস্থান আশা করেছিল। তিনি অন্তত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে নেওয়া প্রস্তাবের নিন্দা বা প্রতিবাদ করতে পারতেন। তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে সৃষ্ট সমস্যা কূটনৈতিকভাবে সমাধানের যে প্রস্তাব দিয়েছেন, আমরা তা সমর্থন করি। কিন্তু তিনি যখন বলেন, এ নিয়ে দেশের ভেতরে নোংরা রাজনীতি করা হচ্ছে, তখনই যুদ্ধাপরাধের বিচারের ব্যাপারে বিএনপির দোদুল্যমানতা প্রকাশ পায়। এমনকি তিনি নিজেও সংকীর্ণ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি।
অন্যদিকে, খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলনে সাম্প্রতিক হরতাল-অবরোধে যেসব হত্যা ও নাশকতার ঘটনা ঘটেছে, তার সব দায় সরকারের ওপর চাপিয়েছেন। অনেক সময় সরকারের বিভিন্ন সংস্থার বলপ্রয়োগ যে পরিস্থিতিকে নাজুক করে, সন্দেহ নেই। কিন্তু যেহেতু আন্দোলনের কর্মসূচি পালন করেছে বিরোধীদলীয় জোট, সেহেতু সেই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সহিংসতার দায় তারাও এড়াতে পারে না।
বিশেষ করে এই সহিংস রাজনীতির সুযোগে যে অগণতান্ত্রিক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে এবং তারা হীন স্বার্থ হাসিলের অপচেষ্টা চালাচ্ছে, যার সঙ্গে গণতান্ত্রিক রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই।
গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিএনপির রাজনৈতিক চরিত্রের সঙ্গে সহিংস রাজনীতির নিশ্চয়ই চারিত্রিক পার্থক্য আছে। কিন্তু সাম্প্রতিক হরতাল-অবরোধের সময় অনেক ক্ষেত্রেই তারা সেই পার্থক্য ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে।
বিএনপি যদি ২৯ ডিসেম্বর ঢাকায় একটি শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করে এবং নির্বাচনের ব্যাপারে দেশবাসীকে তাদের অবস্থান জানায়, সেটি করার অধিকার নিশ্চয়ই তাদের আছে। সরকারের উচিত হবে এ ধরনের কর্মসূচিকে বাধা না দেওয়া। কিন্তু কর্মসূচি ঘোষণাকালে বিএনপির নেত্রী যে চারটি নীতি-কৌশলের কথা বলেছেন, তা পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত করতে পারে। তিনি ‘ভোটকেন্দ্রভিত্তিক সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষা সংগ্রাম কমিটি’ গঠনের কথা বলেছেন। তাহলে সার্বভৌমত্ব কে হরণ করেছে, সেই প্রশ্নটিও আসবে।
তিনি সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেওয়ার কথা বলেছেন। প্রশ্ন আসবে, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা কারা চালাচ্ছে? বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর অনুযায়ী বিরোধী জোটের শরিক মৌলবাদী রাজনৈতিক শক্তিই বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা চালাচ্ছে, পুড়িয়ে দিচ্ছে। এই অগণতান্ত্রিক শক্তিকে নিয়ে কীভাবে তিনি সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেবেন?
সর্বোপরি খালেদা জিয়া যে চলমান আন্দোলনকে আরও বিস্তৃত, ব্যাপক ও পরবর্তী ধাপে উন্নীত করা এবং বাধা দিলে পরবর্তী কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার আগাম ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন, জনগণ তাতে শঙ্কিত না হয়ে পারে না। রাজনৈতিক সংকট নিরসনে বিরোধীদলীয় নেতার কাছে দেশবাসী আরও সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা প্রত্যাশা করে।
তবে বিরোধী দলের অবস্থান যেভাবেই দেখা হোক না কেন, সংকট সমাধানের বলটি এখন সরকারেরই কোর্টে।
ড. ইফতেখারুজ্জামান: নির্বাহী পরিচালক, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
Post a Comment