কারাগার সম্পর্কে আপনার যদি কোনো রকম আগ্রহ থাকে তবে আপনি কাশিমপুর কারাগার-২ এ আসতে পারেন। যে কোনো একটি মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকলে আপনি এই সুযোগ পেতে পারেন। আমি ঘুরে এসেছি। আপনার যদি সৌভাগ্য হয় একজন ডিভিশনপ্রাপ্ত আসামি হওয়ার সে ক্ষেত্রে এই কারাগারের ৭ নম্বর সেলের যে কোনো একটি রুম আপনি বরাদ্দ পাবেন। সুরমা নামের সেলটি লম্বা আকৃতির তিনতলা একটি ভবন। নিচতলার বাম দিকের অংশ ডাইনিং রুম অর্থাৎ আসামিদের খাবার-দাবারের জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে। সিমেন্ট দিয়ে তৈরি লম্বা দুই সারির বেঞ্চ সঙ্গে সিমেন্টের সরু এবং লম্বা টেবিল। দুই সারির দুটি লম্বা টেবিলের দুই পাশে বসার জন্য বেঞ্চে ৪০ জন করে লোক বসলে রুমটিতে একসঙ্গে ৮০ জনের খাবার ব্যবস্থা রয়েছে। সুরমা সেলের নিচতলার ডান দিকে পাশাপাশি বড় বড় দুটি রুম। মাঝখানের সিঁড়ি দিয়ে আপনি যদি দোতলায় উঠে যান তবে ডানে-বামে একই রকম দুই দুই মোট চারটি রুম রয়েছে। একই ব্যবস্থা তিন তলায়ও। আপনি একটু বেশি ভাগ্যবান হলে দোতলার রুমে স্থান পেতে পারেন। নিচতলায় বদ্ধ গুমোট ভাই, পচা মাটির উৎকট গন্ধের সঙ্গে বড় বড় মশার আধিক্য ছাড়াও আরও কিছু নিত্যকার মেহমান আপনাকে দেখতে আসতে পারে। তেলাপোকা, বিছা বা লাল কেড়ার পাশাপাশি কেঁচো, চ্যালা ইত্যাদি দেখতে পাবেন হররোজ। অন্যদিকে তিন তলায় আছে প্রচণ্ড গরমের ভয়। সম্ভবত জলছাদ না থাকার কারণে সূর্যের আলো একটু প্রকট হলেই আপনি ঘামতে থাকবেন। প্রথম কিছু দিন আপনি কষ্ট পেলেও আস্তে আস্তে সব গাসহা হয়ে যাবে।
সাধারণ বন্দীদের বসবাসের জন্যই এটি বানানো হয়েছিল। পরে হয়তো আপনাদের কথা ভেবে কর্তৃপক্ষ এটির নাম দিয়েছে ডিভিশন সেল। সুবিধা এতটুকুই যে, আপনি বড় একটি রুমে একা থাকতে পারবেন যেখানে সাধারণ বন্দী হলে হয়তো নয় কিংবা দশজনকে ঢোকানো হতো। রুমের সঙ্গে সংযুক্ত আছে একটি বাথরুম। সেখানে একটি কমোট একটি শাওয়ার এবং একটি বেসিনও আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছে। প্রথা অনুযায়ী আপনাকে সাহায্য করার জন্য একজন সেবক প্রদান করা হবে সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্য থেকে। আপনার ভাগ্য ভালো হলে আপনি পেতে পারেন মিজানের মতো চমৎকার সেবক বা সাহায্যকারী। বিশাল রুমটিতে আপনি একাও থাকতে পারেন। আবার সেবককেও আপনার সঙ্গে ঘুমানোর অনুমতি দিতে পারেন।
রুমটিতে দুটি লাইট এবং ৬টি ইলেকট্রিক সিলিং ফ্যান রয়েছে। এছাড়া আপনার দরকার হলে ২-৪টি টেবিল ফ্যান বিশেষত চার্জার ফ্যান বাসা থেকে আনিয়ে নিতে পারেন। আর হ্যাঁ চার্জার লাইট, টিভি এবং এক ব্যান্ডের একটি রেডিও আনিয়ে নিতে পারেন। তবে টিভির জন্য অবশ্যই আপনাকে আউট ডোর অ্যানটেনার ব্যবস্থা করতে হবে। টিভিতে শুধু বিটিভির অনুষ্ঠানই দেখতে পাবেন। আপনার জন্য এটি দরকার না হলেও আপনার সেবকের জন্য তা খুবই জরুরি। টিভি বা রেডিও ছাড়া সে আপনার সঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে চাইবে না। আপনাকে এ ব্যাপারে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য এবং খোলামেলা হতে হবে। যাকে বলে উদার। কারণ সে টিভি নাটক বা বাংলা সিনেমা দেখে হো হো করে হাসবে, মাঝে মধ্যে তালি দিবে এবং গালাগালিও করবে। আপনি দয়া করে এসব নিয়ে বিরক্ত হবেন না।
কারাগারের মধ্যে চুল কাটার জন্য খুবই বিনয়ী এবং দক্ষ ১৮ জন নাপিত রয়েছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো লোকটিকে পাঠানো হবে আপনার প্রয়োজনে। পারসোনাল ক্যাশ বা পিসি নামে কারা কর্তৃপক্ষ একটি দোকান চালায়। যদিও দাম একটু বেশি তথাপি এখান থেকে আপনি আপনার প্রয়োজনের সবকিছু কিনতে পারেন। মাছ, মাংস, তরিতরকারী, চা, কপি, হরলিকস থেকে সুই সুতা পর্যন্ত কি নেই এখানে! কেবল অর্ডার দিলেই হলো। এখানকার বাবুর্চিরা বেশ ভালো রান্না করে। কিছু কিছু পদ তো ঢাকার যে কোনো অভিজাত রেস্টুরেন্ট থেকেও ভালো। তারা আবার ফরমায়েশ মতোও রেঁধে দিতে জানে, যেমন আপনি যদি লাল আটার রুটি খেতে চান কিংবা পোলাও-কোরমা, বিরিয়ানি, কালিয়া, কোপ্তা, বোরহানি সবই করাতে পারবেন এদের দিয়ে।
আর হ্যাঁ, একটি ব্যাপারে আপনাকে প্রথম থেকেই খুবই সতর্ক হতে হবে। সেটি হলো আপনার ব্যবহার। এখানে জোর করে আপনি কিছুই পাবেন না। বিনয়, ভদ্রতা এবং ভালো ব্যবহার করলে পুরো কারাগারে আপনার সুনাম ছড়িয়ে পড়বে। জেলের ভিতরে রাস্তায় নামলে কিংবা অফিসে যাবার পথে শত শত বন্দী আপনাকে সালাম দিবে। এখানকার কারারক্ষীদের ব্যাপারেও আপনাকে যথেষ্ট সজাগ ও উদার হতে হবে। কারারক্ষীরা খুবই কম বেতন পান এবং সাধারণ বন্দীরা যেসব খাবার খায় তাদেরও তদ্রুপ খাবার দেওয়া হয়। কাজেই তাদের যদি আপনি একটু আধটু চা খেতে দেন কিংবা এক গ্লাস পানির সঙ্গে দুটো বিস্কুট- তারা যারপর নাই খুশি হয়ে আপনার প্রশংসা ছড়িয়ে দেবে সবখানে। দিনে কারারক্ষীরা আপনার জন্য এক নাগাড়ে ৬ ঘণ্টা ডিউটি করে। আর রাতে ২ ঘণ্টা পর পর শিফট পরিবর্তন হয়। সকাল ৬টার সময় যে দুজন কারারক্ষী আপনার ডিউটিতে এসে রুমের তালা খুলে দেবে তাদের ব্যাপারে আপনার এটা অবশ্যই জানতে হবে যে, তারা না খেয়ে এসেছে। সকালে জেল কর্তৃপক্ষ তাদের কিছুই খেতে দেয় না। ফলে এই দুজন কারারক্ষীকে আপনি যদি সকাল ৮টায় ২-৩টা বিস্কুট, একটু পানি, সঙ্গে রং চা খেতে দেন-তারা আপনার জন্য অন্তঃপ্রাণ হয়ে কৃতজ্ঞতার হাসি উপহার দেবেন প্রতি মুহূর্তে।
আপনি যে সেলে থাকবেন- সেখানে রয়েছে নানা প্রজাতির গাছ। এসব গাছের ঝরে যাওয়া পাতা পরিষ্কার করার জন্য একজন পৌঢ় বন্দী সকাল ও বিকালে আসবেন ঝাড়ু দেওয়ার জন্য। তার চুলে লাল রংয়ের মেহেদি লাগানো। সকালে সাদা লুঙ্গি এবং বিকালে তিনি রঙিন লুঙ্গি পরবেন। বিকাল বেলায় তার দুই কানের সঙ্গে একটি তসবিও ঝুলবে। সেলের ড্রেন ও টয়লেটগুলো পরিষ্কার করার জন্য নিয়োজিত দুজন বন্দীকেও আপনি দেখতে পাবেন সকাল ও বিকালে। তারা কথা একটু কম বলে এবং মুখটা গম্ভীর করে রাখে। আপনার সেলের সামনে প্রায় ২ বিঘার খালি মাঠ রয়েছে। এই মাঠ এবং বিল্ডিংয়ের পেছনের খালি জায়গায় নিয়মিত তরি-তরকারি এবং শাকসবজির চাষ হয়। পেঁপে, ধুন্দল, করলা, ঢেঁড়স, লালশাক, কুমড়াসহ আরও নানা রকমের তরকারি। একটি মাত্র খর্বাকৃতি যুবককে আপনি দেখবেন সকাল এবং বিকাল বেলায় গভীর মনোযোগ দিয়ে তরকারির বাগানে কাজ করে যাচ্ছে। মনে রাখতে আবার ভুলে যাবেন না যে-এগুলোর বীজ ও সার যদি আপনি বা আপনার সহবন্দীরা সরবরাহ করেন তবে উৎপাদিত পণ্যের ওপর আপনার বা আপনাদের অধিকার শতভাগ।
এখানে এসে যদি আপনি অনুদার এবং স্বার্থপর প্রকৃতির মানসিকতা দেখান তবে পদে পদে আপনার কষ্ট ও দুর্ভোগ বাড়তে থাকবে। আপনি ভুলে যাবেন আপনার পদ, মর্যাদা কিংবা বংশ গৌরব। তার চেয়ে বরং নিজকে সাধারণ বন্দী হিসেবে মনে করলে আপনার সম্মান ও মর্যাদা বাড়বে বৈ কমবে না। আপনাকে জানতে হবে এখানকার কর্মপদ্ধতি। ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দী হিসেবে আপনার আত্দীয়স্বজন সপ্তাহে একদিন দেখা করতে পারবেন। তবে মনে রাখবেন অভ্যাগতদের সংখ্যা যেন কোনোক্রমেই পাঁচের অধিক না হয়। অতিথিরা এসে জেল কর্তৃপক্ষের নিকট তাদের নিজেদের নাম ও ঠিকানা লিখিত আকারে দিবেন। নির্ধারিত সময়ে তাদের ভেতরে ডেকে নেওয়া হবে এবং সাক্ষাৎকারের জন্য একটি রুমে বসানো হবে। এরপর একজন কারারক্ষীকে পাঠানো হবে আপনাকে ডেকে নেওয়ার জন্য। আপনি উপস্থিত হওয়া মাত্র সময়ের কাউন্ট-ডাউন শুরু হবে। আপনার জন্য নির্ধারিত সময় মাত্র ৪০ মিনিট। আপনি যখন কথা বলবেন তখন দেখবেন অদূরেই দাঁড়ানো রয়েছে একজন কারারক্ষী। সে দেখবে আপনি বেআইনি কিছু হস্তান্তর করেন কিনা বা কোনো দলিলে স্বাক্ষর করেন কিনা? এসব করা কারা আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ।
জেলখানায় এসেও আপনি কিন্তু আপনার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, অফিসিয়াল দলিল কিংবা চেকবই স্বাক্ষর করতে পারবেন। তবে আপনাকে একটু বাড়তি কষ্ট করতে হবে এ আর কি। আপনার লোকজন সংশ্লিষ্ট কারাগারটি যে এলাকায় অবস্থিত সেখানকার ডিসি অফিসে যাবেন। তারপর নিয়ম অনুযায়ী ডিসি অফিস আপনার পক্ষে তা সরকারিভাবে গ্রহণ করবে। এরপর বেশকিছু ফরমালিটিসের পর সেগুলো জেলখানায় প্রেরণ করা হবে। জেল কর্তৃপক্ষ আবার ডিসি অফিস থেকে প্রেরিত কাগজপত্র তাদের নিয়মমতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং ফাইলবন্দী করার পর আপনার সেলে পাঠাবে স্বাক্ষর করার জন্য। ব্যাস হয়ে গেল। তবে আপনার লোকজন যদি দক্ষ হয় তবে এতসব নিয়মকানুনের দরজা পার হতে ২-৩ কর্মদিবসের দরকার হতে পারে। আর যদি আপনার লোক খুবই উদাসীন প্রকৃতির হন তবে আপনাকে অপেক্ষা করতে হতে পারে অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত।
জেলে ঢোকার পর একজন অনুগত ও দক্ষ বন্দী হিসেবে আপনি যদি মর্যাদা লাভ করতে চান তবে আপনার কারা প্রশাসন সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা থাকতে হবে। জেলকোডের কিছু কিছু ধারা সম্পর্কে জ্ঞান থাকাটাও খারাপ বলে বিবেচিত হবে না। আপনার কারাগারটি অর্থাৎ কাশিমপুর-২ নং জেল বেশ বড়সড় প্রতিষ্ঠান। এখানকার সর্বোচ্চ পদ হলো সিনিয়র জেল সুপার। তারপর রয়েছে জেলার, তারপর ডেপুটি জেলার, সিনিয়র জেল সুপার এবং জেলার থাকেন একজন করে। ডেপুটি জেলার বেশ কয়েকজন। নিচের পদগুলো হলো সুবেদার, জমাদ্দার, প্রধান রক্ষী ইত্যাদি ক্রমানুসারে নেমে গেছে কারারক্ষী পর্যন্ত। সিনিয়র জেল সুপার বা জেলসুপার পদটি মূলত আধা বিচারিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তার পদ। তিনি যে কোনো বন্দীকে শাস্তি দিতে পারেন। এক সেল থেকে অন্য সেলে বদলি করতে পারেন। তাছাড়া বন্দীদের পুরস্কৃতও করতে পারেন। নিয়মানুযায়ী মাসিক ও বাৎসরিক ভিত্তিতে বন্দীদের সাজা কমানোর সুপারিশ তিনিই করে থাকেন। তার ওপর প্রশাসনিক দায়িত্ব তো রয়েছেই। অন্যদিকে জেলার বা ডেপুটি জেলারের পদগুলো মূলত প্রশাসনিক কাজ করে থাকে।
আপনাকে দয়া করে মনে রাখতে হবে যে, এখানে অবস্থানকালীন আপনার সুখ-শান্তি কিংবা মর্যাদা জেলসুপার ও জেলারের সুদৃষ্টির ওপর নির্ভর করে অনেকাংশে। ফলে ভুলেও আপনি তাদের অবমূল্যায়ন করার চেষ্টা করবেন না। বরং খাতির যত্ন ও আদর আত্দি করলে তারা যদি মাঝেমধ্যে আপনার রুমে এসে একটু পদধূলি দেন তবে সব বন্দী ও কারারক্ষী আপনাকেও বিশেষ মর্যাদায় সমীহ করবে।
কারাগার প্রস্তুত-২
ইতোমধ্যেই আপনি কাশিমপুর কারাগারের অনেক কিছু জেনে গেছেন। বাকি রইল শুধু হাসপাতাল ও চৌকা সম্পর্কে। চৌকা হলো রান্নাঘর। এখানে আপনার নিজস্ব অর্থায়নে কেনা জিনিসপত্র রান্না করার জন্য একটি কেন্দ্রীয় চৌকা রয়েছে। একে বলা হয় পিসি চৌকা। আরেকটি হলো সবার জন্য অবারিত রান্নাঘর বা বড় চৌকা। কিছু কিছু খাবার আপনাকে বা আপনার সেবককে আনতে হবে বড় চৌকা থেকে যেমন ভাত, ডাল বা অন্য তরকারি যা কিনা সরকার বন্দী হিসেবে আপনার জন্য বরাদ্দ করেছেন। বাকিটা আপনি আনবেন পিসি চৌকা থেকে যা কিনা আপনি খাবার জন্য ইতিপূর্বে অর্ডার দিয়েছিলেন। সকালের নাস্তা ৭-৮টার মধ্যে আনতে হবে। দুপুরের খাবার বেলা ১টার আগে এবং রাতের খাবার বিকাল ৩টা/সাড়ে ৩টার মধ্যে। নিশ্চয়ই আপনি জেনে যাবেন যে, বিকাল ৪টার মধ্যে চৌকা বন্ধ হয়ে যায় এবং বিকাল ৬টার মধ্যে প্রতিটি সেলের মূল দরজা বন্ধ হয়ে যায়। আর আপনার রুমের দরজায় তালা লাগানো হয় রাত ৮টার মধ্যে। ফলে রাতের খাবার যদি আপনি গরম গরম খেতে চান তবে বেশ বড়সড় একটি হটপট আপনার লাগবে যাতে বিকাল ৩টার সময় খাবার ঢুকালে অন্তত রাত ১০টা পর্যন্ত গরম থাকে।
কারাগারের মধ্যে আপনার জন্য রয়েছে বেশ বড়সড় একটি হাসপাতাল। যেমনি আধুনিক বিল্ডিং তেমনি আধুনিক তার যন্ত্রপাতি। আপনার যদি দাঁতে সমস্যা থাকে তবে হাসপাতালে গিয়ে যেসব যন্ত্রপাতি দেখবেন তাতে আপনার চোখ ছানাবড়া না হয়ে পারবে না। ঢাকার কোনো সরকারি হাসপাতাল তো দূরের কথা বেসরকারি ক্লিনিকেও এত দামি, উন্নতমানের এবং পর্যাপ্ত সংখ্যক যন্ত্রপাতি নেই। হাসপাতালে ওষুধপত্রও যথেষ্ট পাওয়া যায় এবং অবশ্যই বিনামূল্যে। এত বড় হাসপাতাল যদি বাইরে থাকত তবে আপনি কম করে হলেও ৫০/৬০ জন পাস করা ডাক্তারকে সেখানে কর্মরত পেতেন। কিন্তু আপনার কারাগারে মাত্র একজন ডাক্তার। দাঁতের ডাক্তার অবশ্য একজন আছেন। তবে তিনি খণ্ডকালীন। আপনি কিন্তু ভুলেও কখনো ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে একটু বেশি খাতির না করে থাকতে পারবেন না। কারণ এখানে ডাক্তার সাহেবেরও অফুরন্ত ক্ষমতা। আপনার শরীরে জটিল কোনো সমস্যা দেখা দিলে যদি বাইরে থেকে কোনো ডাক্তার আনতে হয় কিংবা ওষুধ তবে প্রথমত কারা ডাক্তারের অনুমোদন লাগবে। আপনি যদি একটু খোলামেলা পরিবেশে তুলনামূলক ভালো খাবার খেয়ে কয়েক দিন হাসপাতালে কাটিয়ে আসতে চান তাহলেও আপনাকে ডাক্তার সাহেবেরই শরণাপন্ন হতে হবে।
আপনি কি আপনার জ্ঞান এই বিশাল কারাগারের একটি মাত্র সেল, হাসপাতাল, অফিস কিংবা চৌকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চান নাকি আরও একটু ঘুরে ফিরে পুরো এলাকাটিতে নজর বুলাতে চান? এই সুযোগও আপনার হতে পারে। তবে এ জন্য আপনাকে কারাগারে থাকতে হবে ঈদের দিন অবধি। ওইদিন কয়েদি/আসামি/বন্দীরা রাস্তায় সীমিত সময়ের জন্য ঘুরতে পারে। একসঙ্গে ঈদের নামাজ আদায় করতে পারে এবং একসঙ্গে খাওয়া দাওয়াও করতে পারে। আপনার যদি কোনো অনুসন্ধিৎসু মন থাকে তবে আপনি বেরিয়ে পড়তে পারেন আপনার সেবককে নিয়ে। খুব দ্রুত কেউ বুঝে ওঠার আগেই আপনি এক দৌড়ে দেখে আসবেন ফাঁসির সেল। টপটেররদের রাখার সেল, দরবার হল এবং বড় বড় কয়েকটি শস্যক্ষেত সেখানে তরিতরকারীসহ নানা জিনিস চাষাবাদ হয়। এগুলোর মালিক অবশ্য জেল কর্তৃপক্ষ। এছাড়াও রয়েছে বিশাল আকৃতির শান বাঁধানো এক দিঘি। স্বচ্ছ এবং নীল রংয়ের পানিতে টইটুম্বর দিঘিতে হরেক রকম মাছের লাফালাফি দেখলে আপনার দুই চোখ জুড়িয়ে যাবে।
আপনি জানতে পারবেন নানা রকম অবরাধমূলক কার্যক্রম এবং এগুলোর বিচার সম্পর্কে। আপনার অপরাধসমূহের তথ্য সংগ্রহ করার জন্য গোয়েন্দারা দিনরাত ঘুরাফিরা করছে। জেলের ভাষায় এদের বলা হয় সিআইডি। এরা খুবই প্রভাবশালী এবং শক্তিশালী। জেলের মধ্যে সিআইডিরা ইচ্ছা করলে বাড়তি আয়ও করতে পারে। আপনি জেলখানার অভ্যন্তরের অপরাধের ধরণ বোঝার জন্য দরবার হলের বিচার কার্যক্রম সম্পর্কে খোঁজ নিতে পারেন। সেখানে গাঁজা, ফেনসিডিলসহ আরও নানারকম মাদকগ্রহণের জন্য অভিযুক্তদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়। বন্দীরা যদি নিজেরা নিজেরা মারামারি করে তবে সেগুলোর বিচারও করা হয় তাৎক্ষণিকভাবে। এর বাইরে আপনি কিছু বন্দীদের দেখা পেতে পারেন যারা ক্ষোভ, হতাশা, কিংবা অভিমানে বিক্ষুব্ধ হয়ে ব্লেড বা ছুড়ি দিয়ে নিজের শরীর ক্ষত-বিক্ষত করে। অনেকে আবার নিজের পেট কেটে নাড়িভুঁড়ি বের করে আত্দহত্যার চেষ্টা চালায়। এসব ক্ষেত্রে জেল কর্তৃপক্ষ অপরাধীদের শাস্তি দিতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খায়। কোনো বন্দী যদি অন্যায় করে তবে তাতে প্রথমত বিচারের মুখোমুখি করে স্বাক্ষ্য প্রমাণ গ্রহণ করা হয়। তারপর অপরাধের ধরন অনুসারে প্রকাশ্য দরবারে বেদম প্রহার করা হয়। অপরাধী বন্দী যদি একটু চালাক হয় তবে চোখের ইঙ্গিতে শাস্তি প্রদানকারী সুবেদার বা সিআইডিকে বাড়তি কিছু দেওয়ার প্রলোভন বুঝাতে পারলে শাস্তির পরিমাণ কমতে পারে। বন্দীদের জন্য শারীরিক শাস্তির পাশাপাশি দীর্ঘস্থায়ী শাস্তি হলো আমদানি সেলে প্রেরণ। এখানে বন্দীদের মানবেতর কষ্টে রাখা হয়। আমদানি সেলে যাওয়া থেকেও বাঁচার উপায় আছে কিংবা সেখান থেকে তাড়াতাড়ি মুক্তিরও সূত্র আছে যা কিনা এখানকার সবাই জানে। আপনি যদি এ ব্যাপারে খুবই হাদারাম প্রকৃতির হন তবে আপনার সঙ্গী-সাথীরা দয়া পরবশ হয়ে আপনাকে ওইসব কায়দা-কানুন শিখিয়ে দেবে।
জেল জীবনে আপনার জন্য সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত হলো সেই ক্ষণটি যখন কোনো প্রিয়জন জেল গেটে আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসে। যেহেতু সুযোগটি আপনি পেতে পারেন সপ্তাহে মাত্র একদিন, সেহেতু দিনটি এবং ক্ষণটির জন্য আপনার দেহ-মন ও মানসিকতা সারা সপ্তাহ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকবে। নির্ধারিত দিনের খুব সকালেই আপনার ঘুম ভেঙে যাবে। তারপর আপনি সেভ, গোসল ইত্যাদি সারবেন খুব তাড়াহুড়ো করে। নাস্তার টেবিলে বসে আপনার জেলমেটদের সঙ্গে যখন নাস্তা খাবেন তখন কারণে-অকারণে আপনি অমনোযোগী হয়ে পড়বেন। অসতর্কতাবশত খাবার চিবানোর সময় আপনি হয়তো নিজের জিহ্বা অথবা ঠোঁটের ভেতরের অংশে কামড় বসিয়ে দিতে পারেন। অন্য সময় যদি আপনি এমনটি করতেন সেক্ষেত্রে হয়তো উহ্ করে জোরে একটি শব্দ করতেন। আপনার প্রিয়জনেরা ছুটে আসলে নির্দি্বধায় বলতেন- জিহ্বায় কামড় পড়েছে। তারা বলত হয়তো তোমাকে কেউ স্মরণ করছে বা গালাগাল দিচ্ছে। আজ কিন্তু আপনি আর উহ্ শব্দটি করবেন না। বরং নিজের দুর্বলতাটুকু ঢাকার জন্য বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে সবার মুখের দিকে তাকাবেন। তারপর নিজে নিজেই আত্দতৃপ্তি লাভ করবেন এবং মনে মনে বলবেন, নাহ্ কেউ টের পায়নি।
নাস্তার খাওয়ার পর সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে আপনি হয়তো চা বা কফি খাবেন। কিন্তু আপনার দৃষ্টি বারবার নিচে চলে যাবে। আপনি অধীর আগ্রহে কোনো সাইকেলের টুং টাং ঘণ্টার ধ্বনির জন্য অপেক্ষা করবেন। একসময় যখন কাঁটায় কাঁটায় সকাল ১০টা বেজে যাবে ঠিক তখনই সাইকেলে টুং টাং শব্দ করে একজন কারারক্ষী নিচতলার গেটের সামনে এসে বলবেন- স্যার দেখা আসছে। আপনারা সবাই একসঙ্গে চেঁচিয়ে বলবেন- কার দেখা আসছে। কারারক্ষী বলবে মাহমুদ স্যারের। সঙ্গে সঙ্গে মাহমুদুর রহমান ওঠে আপনাদের দিকে বিজয়ের হাসি হেসে খুব দ্রুত কারারক্ষীকে অনুসরণ করবেন। এরপর আপনারা সবাই মিসেস মাহমুদের পাংচুয়ালিটি নিয়ে প্রশংসা করতে করতে যার যার রুমে চলে যাবেন।
রুমে ফেরার পর আপনি অকারণে অস্থির হয়ে পড়বেন। একবার হয়তো আপনার বাথরুমে যেতে ইচ্ছা করবে। কিন্তু পরক্ষণেই আপনি বাথরুমে যাওয়ার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবেন। আপনার মনে হতে পারে, বাথরুমে থাকার সময় যদি কারারক্ষী আপনাকে ডাকতে আসে! এভাবে আপনার পায়চারী এবং অস্থিরতা ক্রমাগত বাড়বে। আপনি এ সময় ২/৩ গ্লাস পানি পান করবেন এবং বার বার ঘড়ির দিকে তাকাবেন। প্রায় ১১টা বাজতে চলল। এখনো ডাক পড়ল না! তবে কি তারা আসবে না? নাকি পথে কোনো বিপদ হলো। বিপদের কথা ভাবতেই আপনার অন্তরাত্দা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। আপনি আরও ২/৩ গ্লাস পানি খেলেন। এবার আর বাথরুমে না গেলেই নয়। আপনি গেলেন বটে কিন্তু মনোযোগ রইল সাইকেলের ঘণ্টার দিকে। ঠিক সোয়া ১১টার সময় আপনার ডাক এলো। আপনিও যথাসাধ্য দ্রুত গন্তব্যের দিকে রওয়ানা হলেন। আপনার পা আজ অস্বাভাবিকভাবে ছুটছে। এত গতি যে আপনার পায়ের মধ্যে লুকানো ছিল তা আপনি আজই টের পেলেন যখন আপনার নজর পেছনে পড়া কারারক্ষীর ওপর পড়ল। সে তখন রীতিমতো দৌড়াচ্ছে আর হাঁফাচ্ছে কেবল আপনাকে অনুসরণ করার জন্য।
ভিজিটর রুমে গিয়ে আপনার নজর পড়বে প্রথমে স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিদের দিকে। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে গভীর মমতায় আপনার হৃদয় হাহাকার করে ওঠবে। আপনি মনে মনে চিন্তা করবেন অনেক পুরনো স্মৃতি। তারপর সব দোষের জন্য নিজেকেই দায়ী করবেন আর আফসোস করবেন মুক্ত জীবনের নষ্ট হয়ে যাওয়া সেই স্বর্ণালী মুহূর্তগুলোর কথা, যা আপনি নিতান্ত অবহেলায় স্ত্রীকে না দিয়ে শুয়ে শুয়ে টিভি দেখেছেন কিংবা বিনা কারণে কোনো বন্ধুর সঙ্গে রেস্টুরেন্টে আড্ডা মেরেছেন। আপনার ছোট ৯/১০ বছরের ছেলেটি ওঠে এসে আপনাকে জড়িয়ে ধরবে। আপনি নিবিড় মমতায় নিচু হয়ে ছেলেটিকে বুকে চেপে ধরবেন আর তার শরীরের সবটুকু ঘ্রাণ নাকে ধারণ করার জন্য চোখ বুজে আলিঙ্গনরত থাকার চেষ্টা করবেন। আপনার ১৩/১৪ বছরের কিশোরী মেয়েটি আপনাকে খোঁচা দিয়ে বলবে- বাবা এবার আসি- বলেই সে আপনার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আপনি মেয়েটির মায়াভরা মুখটির দিকে তাকিয়েই বুঝবেন সে অনেকটা শুকিয়ে গেছে। মুখে একটা ব্রণও উঠেছে। নিশ্চয়ই ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করছে না এবং ঘুমাচ্ছেও না। অন্য সময় হলে বিশেষত বিদেশ থেকে অনেক দিন পর বাসায় ফিরে প্রথম দর্শনেই আপনি সন্তানদের কিছু ত্রুটি ধরতে চেষ্টা করতেন। কিন্তু নিজের অসহায়ত্বের কারণে ওই ধরনের প্রশ্ন করার সাহস আজ আপনি হারিয়ে ফেলবেন। আপনার কলেজপড়ুয়া ছেলেটিও দাঁড়িয়ে আছে আপনার সঙ্গে আলিঙ্গন ও চুমু বিনিময় করার জন্য। বয়স মাত্র উনিশ কি কুড়ি হবে- কিন্তু গত এক মাসের মধ্যেই ও কেমন যেন গম্ভীর আর ম্রিয়মাণ হয়ে পড়েছে। আপনার আরও কয়েকজন আত্দীয় এসেছেন। তাদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর আপনি বসলেন। আজ আর কথা শেষ হতে চায় না। কত যে কথার ফুলঝুরি মনের গভীর থেকে বের হচ্ছে তো হচ্ছেই- কিছুতেই থামতে চায় না। উপস্থিত সবাই শুধু আপনার কথাই শুনতে চায়। একটু পর যখন খেয়াল করলেন যে, অভ্যাগতদেরও অনেক কথা বলার আছে- তখন আপনার জন্য নির্ধারিত সময় প্রায় শেষ হয়ে এসেছে এবং ডেপুটি জেলার এসে সালাম দিয়ে সে কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার পর আপনি শুরু করলেন তাড়াহুড়ো। অনেক কথা শোনা হলো না কিংবা কোনো কথা বলা হলো না। সবাইকে বিদায় করে দিয়ে আপনি পুনরায় মাথা নিচু করে জেলখানায় ঢুকলেন। (চলবে)
- See more at: http://www.bd-pratidin.com/2013/10/20/22118#sthash.OvdyTHFh.dpuf
Post a Comment