কলঙ্কিত মুখ দেখানো যাবে না : রনি
চলমান রাজনৈতিক সহিংসতা নিয়ে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য, তরুণ রাজনীতিক গোলাম মাওলা রনি বলেছেন, "বারবার মনে হচ্ছে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে যাই- কিন্তু একজন ব্যর্থ রাজনীতিবিদ হিসেবে আমার কলঙ্কিত মুখ ওইসব আগুনে পোড়া মানুষজনকে যে দেখানো যাবে না- এতটুকু চেতনা এখনো ধারণ করছি বলেই আমার মনোজগতে অনেক উথালপাথাল হচ্ছে প্রতিমূহুর্তে।"
সোমবার বিকেল সাড়ে ৪টায় গোলাম মাওলা রনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তার প্রোফাইলের ওয়ালে এসব কথা লিখেন।
তিনি বলেন, "ঢাকা মুলত: এই মূহুর্তে সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন। আপনি যদি নিউমার্কেট অথবা মোহাম্মদপুর কাঁচাবাজারে যান, তাহলে দেখবেন সেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় কাঁচামালের কী রূপ হাহাকার যাচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-অভিভাবক-শিক্ষার্থীরা গুমরে গুমরে কাদঁছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলের অফিসের সামনে কিছু কর্মী নিয়ে কয়েকজন নেতাগোছের মানুষ মুচকি মুচকি হেসে ক্যামেরায় পোজ দিচ্ছে। শহরের যেকোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যান এবং শুনুন সবার কথা। বিশ্বাস না হলে তাদের কাগজপত্র পরীক্ষা করুন- দেখবেন সকলেই হয় ইতিমধ্যে দেউলিয়া হয়ে গেছে, নয়তো দেউলিয়া হওয়ার পথে। এরপর আপনি তাদের মনের কথা জানার জন্য সম্প্রতি আবিস্কৃত হওয়া যন্ত্রটির সাহায্য নিন এবং ভালো করে শুনুন তারা কি আপনাকে অভিশাপ দিচ্ছে না অন্য কাউকে?"
গোলাম মাওলা রনির স্টাটাসটি হুবহু পরিবর্তন পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো। শুধু বানান সংশোধন করা হল।
"মাগো! চারিদিকে বারুদ, ঢাকাবাসীর চাপা কান্না এবং দেশবাসীর আর্তনাদ কি শুনতে পাচ্ছেন!
কযেকদিন যাবৎ ঘুমাতে পারছি না। পরিবার পরিজন, বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিত জনের কাউকেই হাসতে দেখিনি কয়েকমাসে। রুটি রুজির জন্য অফিসে আসতে হয়। আমার গাড়ির গ্লাসটি ককটেলের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্থ হবার পর রিকশায় ঘুরে বেড়াই। বাসে উঠতে ভয় পাই গান পাউডারের অগ্নিতে কাবাব হবার আশঙ্কায়। শরীর-মন হাহাকার করছে- এক অজানা শঙ্কায়- বিশেষ করে গাজীপুরে স্ট্যান্ডার্ড গার্মেন্টস পুড়ে ১২০০ কোটি টাকার ক্ষতি এবং অসহায় মালিকের গগনবিদারী কান্না দেখার পর বার বার মনে হচ্ছে, ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে যাই- কিন্তু একজন ব্যর্থ রাজনীতিবিদ হিসেবে আমার কলঙ্কিত মুখ ওইসব আগুনে পোড়া মানুষজনকে যে দেখানো যাবে না- এতটুকু চেতনা এখনো ধারণ করছি বলেই আমার মনোজগতে অনেক উথালপাথাল হচ্ছে প্রতিমূহুর্তে।
সন্ধ্যার পর ঢাকা ভূতুরে নগরী হয়ে যায়। দিনের বেলায় সবাই চলে ইতিউতি চোখ নিয়ে- সর্বদা একই ভয়- এই বুঝি কেউ এলো, আর ককটেল মেরে দৌড় দিলো। টেলিভিশনে পুলিশের কিছু তৎপরতা দেখা যায়। কিন্তু নাগরিক হিসেবে রাস্তায় চললে দেখবেন- কোন এক জায়গায় বেঞ্চ পেতে তারা অলস সময় কাটাচ্ছে। টহলরত অবস্থায় পুলিশের গাড়ি দেখা যায় কালেভদ্রে। রাতের বেলায় তারা একদমই চলে না। মাঝে মধ্যে হুইসেল বাজিয়ে ৩/৪ টি পুলিশের গাড়ি চলে যায় ব্যস্ত সড়ক দিয়ে। অবস্থা দেখে মনে হয়, তারা হুইসেল বাজিয়ে কাউকে নিরাপদে সরে যাবার আহবান করছে।
ঢাকা মূলত: এইমূহুর্তে সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন। আপনি যদি নিউমার্কেট অথবা মোহাম্মদপুর কাঁচা বাজারে যান তাহলে দেখবেন সেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় কাঁচামালের কী রূপ হাহাকার যাচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক- অভিভাবক- আর শিক্ষার্থীরা গুমরে গুমরে কাদঁছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলের অফিসের সামনে কিছু কর্মী নিয়ে কয়েকজন নেতাগোছের মানুষ মুচকি মুচকি হেসে ক্যামেরায় পোজ দিচ্ছে। শহরের যেকোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যান এবং শুনুন সবার কথা। বিশ্বাস না হলে তাদের কাগজপত্র পরীক্ষা করুন- দেখবেন সকলেই হয় ইতিমধ্যে দেউলিয়া হয়ে গেছে, নয়তো দেউলিয়া হওয়ার পথে। এরপর আপনি তাদের মনের কথা জানার জন্য সম্প্রতি আবিস্কৃত হওয়া যন্ত্রটির সাহায্য নিন এবং ভালো করে শুনুন তারা কি আপনাকে অভিশাপ দিচ্ছে না অন্য কাউকে?
বিভাগীয় শহর, জেলা শহর এবং প্রত্যন্ত গ্রাম্য হাটবাজারে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। ঠিক যেনো জাতিগত দাঙ্গার মতো, যেমনটি হয়েছিলো ভারত ভাগের পর। এ দেশের টিভিগুলো নৈতিক কারণে অনেক কিছু প্রকাশ করছে না বা পারছে না। কিন্তু বিদেশী টিভিতে যা দেখাচ্ছে তাতে পরিস্থিতি সিরিয়া, কাবুল বা কান্দাহারের চেয়েও ভয়াবহভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে। আর এসব দেখে বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা ওই দেশীয় লোকদের নিকট শরমে মরমে মরে যাচ্ছে, আর দেশে বসবাসরত তাদের আত্নীয়-স্বজনের জন্য কান্নাকাটি করছে।
এতসব তাণ্ডবের মধ্যে নির্বাচনের চেষ্টা হচ্ছে। ঢোল, ডগর বাঁজিয়ে একদল নাচছে আর একদল 'ভি' চিহ্ন দেখিয়ে রাজপথ প্রকম্পিত করছে- ঠিক যেনো নজরুলের কবিতার মতো- আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি। তারা সবাই আপনার সামনে বীরত্ব দেখিয়ে হম্বিতম্বি করে, আর পর্দার আড়ালে এসে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে ভিন্ন কথা বলে। ভিন্নচিত্রও অবশ্য আছে- কেউ কেউ আপনাকে পতনের অতলান্তে নিয়ে যাবার জন্য ঠাণ্ডা মাথায় অনেক কিছু করছে। আপনি তো অবশ্যই জানেন, অতিরিক্ত তৃষ্ণার্ত মানুষকে হঠাৎ করে ঠাণ্ডা সুপেয় পানি দিলে লোকটির কী অবস্থা হয়? সে পানি খেয়ে মারা যায় অথবা আপনার হাত থেকে পানি ছিনিয়ে নেবার জন্য আপনার ওপর যেকোন জঘন্য অনাচার ঘটিয়ে দেয়।
যারা একবার আপনার শত্রু হয়ে গেছে তারা কখনো বন্ধু হবে না। আপনি দীর্ঘদিন যাদের অপমানিত করেছেন, আপনার প্রয়োজনে তাদের যদি সম্মানিত করেনও সেক্ষেত্রে তাদের প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়- আপনার প্রতি প্রতিশোধ নিয়ে নিজেদের অতীত অপমানের ঝাল মেটানো এবং তৎপর উল্লাস নৃত্য করা। আপনি বিশ্বাস করুন- দীর্ঘ ইতিহাসের পথ পরিক্রমায় এর ব্যতিক্রম ঘটেনি একবারের জন্যও, বিশেষত রাজনীতিতে। হায় আল্লাহ্! শেষ মূহুর্তে কেন আপনি সেই উদারতা কিংবা দূর্বলতা দেখিয়ে পুরস্কারগুলো দিলেন যার জন্য তারা বহু বছর ধরে অপেক্ষা করছিলো?
১৭৫৭ সালের এপ্রিল-মে মাসের কিছু ঘটনা যা কিনা ঘটেছিলো মুর্শিদাবাদের রাজদরবারে, তার সঙ্গে আপনার জীবনের কিছু উপাখ্যান ইচ্ছে করলে মিলিয়ে নিতে পারেন। প্রথম থেকে নবাব সিরাজউদ্দৌলা রাজ্যের সিনিয়র কিছু আমির-ওমরাদের অপছন্দ করতেন এবং উঠতে বসতে অপমান করতেন। একবার তাদের রাজদরবারে গ্রেফতারও করে বসেন। তারপর আবার তার চারিত্রিক দূর্বলতার কারণে আমির-ওমরাদের ছেড়ে দেন। ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধের ঠিক এক মাস আগে নবাব তার ৫৩ হাজার সদস্যের সেনাবাহিনীর মূল কমান্ড তাদের হাতে দিয়ে দেন যাদের তিনি এতকাল অপমান করে আসছিলেন। অন্যদিকে নিঃস্বার্থভাবে যারা তাকে ভালোবাসতো সেইসব জেনারেলকে রাজধানী রক্ষার দায়িত্ব দিয়ে তিনি নিজে রণাঙ্গনে উপস্থিত হলেন। চক্রান্তকারীরা যুদ্ধক্ষেত্রে এসে নবাবের তাবু এমনভাবে সুরক্ষিত করলো যে মোহন লাল, মীর মদনরা তার সঙ্গে দেখা করার সুযোগও পেলো না।
আপনাকে আমি ইতিহাসের শ’খানেক উদাহরণ দেখাতে পারবো যেখানে গত একহাজার বছরে বারবার একই ভুল করা হয়েছে এবং হুবহু একই পরিণতি হয়েছে। আমার প্রশ্ন কেনো এমনটি হয় বারবার! এর উত্তর কিন্তু আঁতেল প্রকৃতির লোকেরা দিয়ে গেছেন যাদের আবার আপনারা ভারী অপছন্দ করে থাকেন। মানুষ একটা সময় এসে নিজেকে অতিমানব ভাবতে শুরু করে। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ এবং নিজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা একটি নফস যার নাম ‘এজাহারে তাজাল্লুল’- এর প্রভাবেই এমনটি হয়ে থাকে।
অনেকে দেশের মানুষকে আনুগত্যহীন ও অস্থির প্রকৃতির বলে গালি দিতে চায়। কিন্তু আমার মনে হয়, উত্তম শাসকের অভাবে মানুষ অস্থিরতা দেখায়। এই বাংলায় শশাংক, সামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ, হোসেন শাহ কিংবা শায়েস্তা খানের মতো শাসক ছিলেন যারা একেকজন ২০/৩০ বছর একনাগারে শাসন করেছেন। তখন বিদ্রাহ ছিলো না, অপরাধীও ছিলো না এবং কারাগারগুলো বলতে গেলে খালি ছিলো। পাল বংশ এক নাগারে ৪০০ বছর নির্বিঘ্নে রাজত্ব করলো আর আমরা চার বছর পার করতে পারছি না। রাজার সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য হলো তার ন্যায়পরায়ণতা, আর রাজাকে শেষ করে দেয় তার মোনাফিকী এবং অন্যায় আচরণ।
মানুষ হিসেবে আপনি যদি সম্রাট শাহজাহানের সেই গল্পটির ইতিকথা স্মরণ করেন, তবে অনেককিছুই এমনিতেই সমাধান হয়ে যাবে। দিল্লীতে কায়েস নামক এক বৃদ্ধ ভিক্ষুক ছিলো। বহুবছর ভিক্ষা করার পরও তার চালচুলো কিছুই হলো না দেখে শহরবাসী মুরুব্বীরা সহানুভূতি জানিয়ে বললো- কী গো কায়েস তোমার তো কিছুই হলো না। তুমি কি সারাজীবন ভিক্ষা করেই যাবে? ভিক্ষা ছাড়া আর করবোই বা কী! লোকজন তো এক পয়সার বেশি দেয় না- তাও আবার সবাই দেয় না। হবে কিভাবে! কায়েস উত্তর করলো। লোকজন বললো- বাদশার কাছে যাও। তিনি মস্ত বড় দাতা। একবার দিলে আর জীবনে ভিক্ষা করতে হবে না। কায়েস বললো- কিভাবে যাবো? রাজ দরবারে তো কোন ভিক্ষুক ঢুকতে দেয় না। বাদশাহ রাজপথে নামার আগে প্রহরীরা সেখানকার সব ভিক্ষুক তাড়িয়ে দেয়। লোকজন বললো- তুমি এখন দিল্লী জামে মসজিদে যাও। বাদশাহ নামাজ পড়ছেন। তুমি মুসল্লির বেশে ঢুকে অপেক্ষা কর এবং নামাজ শেষে তাকে সালাম দিয়ে মনের দুঃখ বল। কায়েস সত্যিই মসজিদে ঢুকলো এবং দেখল বাদশাহ নামাজ শেষে মোনাজাত করছেন। হাউমাউ করে অঝরে কাদছেন। অনেকক্ষণ দাড়িয়ে কায়েস ভারী আশ্চর্য হয়ে বাদশার কান্নাকাটি দেখলো। মোনাজাত শেষে বাদশাহ উঠে দাড়ালেন এবং অশ্রুসজল নেত্রে কায়েসের দিকে তাকিয়ে সালাম দিলেন। বাদশার মন ছিলো ওই মূহুর্তে যথেষ্ট নরম এবং অহংকারমুক্ত। কায়েস সালামের উত্তর দিয়ে মসজিদ থেকে বের হতে উদ্যত হলো-
বাদশাহ কায়েসকে ডাক দিলেন। বললেন- তোমাকে দেখেতো একজন ভিক্ষুক বলেই মনে হচ্ছে। আরো মনে হচ্ছে তুমি হয়তো আমার কাছে কিছু চাইতে এসেছিলে। আমার কাছে যারা আসে তারা তো কিছু না চেয়ে ফেরত যায় না। অথচ কী আশ্চর্য তুমি ফেরত চলে যাচ্ছো! কায়েস বললো- হে বাদশাহ নামদার! আপনি ঠিকই ধরেছেন যে আমি একজন ভিক্ষুক এবং আপনার নিকট ভিক্ষা চাইতে এসেছিলাম। কিন্তু আপনাকে দেখে আমার জ্ঞানের চক্ষু খুলে গেছে। আমি মানুষজনের কাছে ভিক্ষা চাই, কিন্তু জীবনে কোনোদিন কান্নাকাটি করিনি। কিন্তু আজ আমি দুনিয়ার সবচেয়ে বড় শাহনশাহকে দেখলাম অন্য কারো নিকট আমার চেয়েও বড় ভিক্ষুক হয়ে চোখের পানি ফেলে ভিক্ষা চাইতে। কাজেই এখন থেকে আমি তারই কাছেই সবকিছু চাইবো যার নিকট শাহেনশাহ ভিক্ষার হাত বাড়ান।"
যাকা/রর
Post a Comment