কারাগার প্রস্তুত, আমি ঘুরে এলাম, আপনি যাচ্ছেন তো? (শেষ পর্ব)
গোলাম মাওলা রনি
কারাগার প্রস্তুত, আমি ঘুরে এলাম, আপনি যাচ্ছেন তো? (শেষ পর্ব)
মূল কারাফটক থেকে আপনার ৭ নম্বর সেলে হেঁটে আসতে ৮-১০ মিনিট লাগে। যাওয়ার সময় আপনি মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যেই পেঁৗছেছিলেন। কিন্তু ফেরার পথে কম করে হলেও ১৫ মিনিট লাগল। রাস্তায় অনেক বন্দীর সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ ও সালাম বিনিময় হলো। কিন্তু আপনার উদাসী মন তখন মায়ের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। গত সপ্তাহে তিনি এসেছিলেন। আপনি তার কিশোরী বয়সের প্রথম সন্তান। অনেক দুরন্তপনা, দুষ্টুমি এবং প্রতিনিয়ত নানা রকম অন্যায় করার পরও তিনি কখনো আপনাকে গায়ে হাত দিয়ে শাসন করেননি। সারা জীবন আপনি তার হাসিমুখ দেখতে দেখতেই ৪৮ বছর পার করেছেন। জীবনে দ্বিতীয়বার তাকে আপনি কাঁদতে দেখেছেন জেল গেটে। প্রথমবার তিনি কেঁদেছিলেন আপনার পিতার মৃত্যুর পর। দ্বিতীয়বার কাঁদতে গিয়ে তিনি আপনাকে জড়িয়ে ধরে মাতৃসুধা দিলেন বহু বছর পর। কিন্তু সেদিনের সেই মাতৃসুধা আপনাকে শান্তি দিতে পারেনি। অশান্তির অনল আপনার হৃদয়কে এমনভাবে অঙ্গারে পরিণত করেছে যে এখনো সেখান থেকে কয়লা পোড়া গন্ধ বের হচ্ছে।
সঙ্গী কারারক্ষী আপনাকে ৭ নম্বর সেলের মূল ফটক পার করিয়ে ভবনটির সামনে নিয়ে আসবে। তার দায়িত্ব রুম পর্যন্ত পেঁৗছে দেওয়া। আপনি স্মিতহাস্যে বলতে পারেন, ধন্যবাদ আর লাগবে না। দেখবেন সেও স্মিতহাস্যে আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বিদায় নিচ্ছে। এরপর সিঁড়ি দিয়ে ধীরেসুস্থে উঠবেন। একটু বেশি সতর্কতার জন্য হয়তো সিঁড়িতে স্থাপন করা কাঠের রেলিং ধরে বয়স্ক হওয়ার ভান করে হেলেদুলে আপনি উঠতে থাকবেন। আপনার আত্দবিশ্বাসে হয়তো একটু ঘাটতি দেখা দেওয়ার কারণে মনে হয়েছিল রেলিং ধরে উঠলে পা ফসকে পড়ার সম্ভাবনা কম। রুমে ঢুকেই আপনি কিছুক্ষণের জন্য বিছানায় নিজেকে এলিয়ে দেবেন। মাথার ওপর ঘূর্ণায়মান ফ্যানটির দিকে নজর রাখতে গিয়ে আপনাকে অবশ্যই চিৎ হয়ে শুতে হবে। বেশ কিছুক্ষণ আপনি ম্রিয়মাণ হয়ে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকবেন। এ সময় আপনি হয়তো কিছুই ভাববেন না। নীরব নিস্তব্ধ দুপুর বেলায় আপনি যদি কানকে সজাগ রাখেন তবে কিছু পাখ-পাখালির কিচির-মিচির, পাশের রাস্তার অস্পষ্ট কোলাহল কিংবা পাশের কোনো বাথরুমে জোরে জোরে কল থেকে পানি পড়ার শব্দ শুনতে পাবেন। এসব কোনো কিছুই আপনার চিন্তাজগতে প্লাবন করবে না। আপনি কেবলই শুয়ে থাকবেন এবং চারদিকের নিঃসঙ্গতা অনুভব করবেন। এভাবে যে কত সময় পার হতো তা আপনি টেরই পেতেন না যদি আপনার সেবক রুমে ঢুকে আপনাকে নামাজ এবং দুপুরের খাবারের সময় হয়েছে- এ কথা স্মরণ না করিয়ে দিত। এরই মধ্যে বেশ কিছু দিন কারাবাসের কারণে আপনি পারিপাশ্বর্িক পরিবেশ এবং জেলজীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। সব কাজই নিয়মিতভাবে করার চেষ্টা করছেন। আপনার এসব কাজকর্ম সম্পর্কে মানুষকে ধারণা দেওয়ার আগে আপনার মনে পড়ল এ জেলের প্রথম সকালের সূর্যোদয় এবং পরিবেশ ও প্রতিবেশ সম্পর্কে। সকাল বেলা ফজরের নামাজ পড়ার পর অভ্যাসবশত আপনি সামনের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন। সূর্য তখনো ওঠেনি। আকাশ মেঘলা। কিছুটা গুমট গুমট ভাব। প্রচণ্ড ক্লান্তির কারণে প্রকৃতির এই ভাবসাব আপনি রাতে ঘুমানোর সময় একদমই টের পাননি। অনেক দিন পর সম্ভবত আপনি সড় সড় আওয়াজে নাকও ডেকেছিলেন। সকালের গুমট আবহাওয়ার কারণে আপনার মনে হলো হয়তো বৃষ্টি আসবে। আপনি প্রকৃতির দিকে তাকাতে তাকাতে বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করলেন। কারণ একটাই- বৃষ্টির টাপুর-টুপুর শব্দ শুনতে শুনতে আবার ঘুমাতে যাবেন। এমন সময় দু-তিন দফা ঠাণ্ডা বাতাসের প্রবাহ আপনাকে পাগল করে তুলল। আপনি কোনো কিছু না ভেবেই স্যান্ডেল পায়ে চালিয়ে নিচে নেমে এলেন।
ভোরের বাতাস খেতে খেতে আপনি নিচে ধীরে ধীরে পায়চারী শুরু করলেন। রাতে ঢোকার সময় আপনি আসলে কিছুই লক্ষ্য করেননি। নিচে নামার সঙ্গে সঙ্গে সামনের মাঠে এক জোড়া শালিক আপনাকে স্বাগত জানাল। আপনি লক্ষ্য করলেন মাঠের মধ্যে ৩০-৪০টি শালিক মনের সুখে বিচরণ করছে আর ঘাসের দানা খাচ্ছে। তারা আপনাকে দেখে একটুও বিরক্ত হলো না বা ভয় পেল না। ২-৪ জোড়া শালিক আপনার প্রেমে মুগ্ধ হয়ে আরও একটু সামনে নাচতে নাচতে এগিয়ে এলো। আপনি লক্ষ্য করলেন একটু দূরে কয়েকটি ঘুঘু আপন মনে ঘোরাফেরা করছে। আপনি বেশ অবাক হলেন- আপনাকে নিয়ে ঘুঘুদের নির্লিপ্ততা দেখে। আরও কয়েকটি নাম না জানা রঙিন পাখি আপনার পাশ দিয়ে উঠে গেল এবং নিকটস্থ অর্জুন গাছে গিয়ে বসল। আপনি তাদের নিয়ে ভাবতে যাচ্ছেন তখন তারা আপনাকে একলা পেয়ে আবার কিচির-মিচির শব্দ করে আপনার পাশ দিয়ে উড়ে গেল।
সকালের স্নিগ্ধ বাতাসে আপনি জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে এগোতে থাকলেন সেলটির প্রবেশপথের দিকে। দরজার একটি অংশ খোলা। বাইরে একজন কারারক্ষী পায়চারী করছে। আপনি ডান দিকে তাকিয়েই দেখলেন চমৎকার ছিমছাম একটি বকুল গাছ। অনেক বকুল ফুল মাটিতে পড়ে আছে। তাজা ফুলের গন্ধে আপনার মন তখন মৌ মৌ করছে। আপনি একটু নুয়ে বেশ কয়েকটি বকুলফুল তুলে যেই না নাকের কাছে ধরেছেন অমনি আপনার মনে পড়ে গেল বাল্যকালের পাঠশালায় পড়া বকুলী নামের বালিকাটির কথা। আপনি তখন ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। হাইস্কুলসংলগ্ন পাঠশালায় শিশু শ্রেণীতে পড়ত বকুলী। আপনি প্রথম দেখাতেই মুগ্ধ হয়ে গেলেন। শিশুটি লক্ষ্য করল জানালা দিয়ে কেউ তাকে মুগ্ধ চোখে দেখছে। সেও একবার জানালার দিকে হাসি হাসি মুখে তাকায় আবার গুরুজির দিকে তাকিয়ে পড়াশোনায় মন দেওয়ার চেষ্টা করে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও আপনার চোখের তৃষ্ণা মেটেনি। কতই বা হবে শিশুটির বয়স তখন! বড়জোর ছয়-সাত কিংবা আট বছর। আপনি নিজের ক্লাসে ফিরে এলেন এবং দুজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে ঘটনাটি বললেন। আপনারা তিনজনে মিলে সময় পেলেই পাঠশালার সেই জানালার কাছে যেতেন। এর কিছু দিন পরই আপনি ওই স্কুল ছেড়ে বাবার কর্মস্থলের স্কুলে ভর্তি হলেন। এই দীর্ঘজীবনে শৈশবের সেই কথা আপনি ভুলতেই বসেছিলেন। কিন্তু বকুলফুলের সুগন্ধে ফিরে এলো আপনার সেই আনন্দময় শৈশবের একটি ভালোলাগার স্মৃতি। সম্ভবত জীবনের প্রথম ভালোবাসা।
বকুলতলা থেকে আপনি হাঁটতে হাঁটতে ওয়াকওয়েটির অন্য প্রান্তে যেতে যেতে মনে মনে ভাববেন আরসিসির রাস্তাটি লম্বায় আর কত বড় হতে পারে। সম্ভবত ১৫০ ফিটের মতো। আর এটির আকৃতি ইংরেজি জেড অক্ষরের মতো। ওয়াকওয়েটির শেষপ্রান্তে রয়েছে একটি গণটয়লেট। ডিভিশন সেলে রূপান্তরের আগে বন্দীরা হয়তো এই গণটয়লেট ব্যবহার করত। চারটি মাত্র টয়লেট। আড়াই ফুট উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। এখন ডিভিশন সেলের সেবকরা দিনের বেলায় এবং কারারক্ষীরা সার্বক্ষণিকভাবে এগুলো ব্যবহার করে। যেহেতু কোনো উৎকট গন্ধ বের হচ্ছে না কাজেই আপনি ধরে নিতে পারেন ওগুলোও বেশ পরিষ্কার। এই টয়লেটগুলোর পাশে রয়েছে আরও একটি বড় বকুল গাছ। এরই মধ্যে আপনি দেখে ফেলেছেন টয়লেটের পাশে গণগোসলখানা এবং এর পাশে একটি ছোট্ট অব্যবহৃত রান্নাঘর। কিন্তু আপনার এসবে বেশি মনোযোগ নেই। আপনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন ওয়াকওয়ের এক পাশে অর্থাৎ সেলটির সামনের অংশে বহু রকম ফুল ও পাতাবাহারির গাছ। অন্যদিকে রয়েছে হরীতকী, অর্জুন, বহেড়া, নিম, কাঁঠালচাঁপা, আম, কাঁঠালসহ আরও নানা রকম গাছ। তবে নিমের সংখ্যাই বেশি। একটি নিম গাছে ফুটে আছে শত শত ধুন্দলফুল। সংলগ্ন দেয়ালের সঙ্গে আবাদ করা ধুন্দল গাছটি সুযোগ পেয়ে নিম গাছটিকে অাঁকড়ে রয়েছে। আর নিম গাছের সারা শরীর তার ফুল দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছে। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আপনি আর নিচে থাকতে পারলেন না। আপনার প্রিয় বৃষ্টি এসে আপনাকে আবার ঘুমের রাজ্যে পাঠানোর বার্তা দিয়ে গেল।
এরই মধ্যে আপনার কারাবাসের সময় মোটামুটি অনেক দিন পার হয়ে গেছে। প্রথম দিন হয়তো ভেবেছিলেন দু-এক দিনের মধ্যে জামিন হয়ে যাবে। আপনাকে হতবাক এবং আশাহত করে নিম্ন আদালতের প্রতিটি স্তরে এ জামিন আবেদন বাতিল হওয়ার পর আপনি জেলজীবন নিয়ে নতুন করে হিসাব কষতে বসেছেন। আপনি আপনার দৈনন্দিন সমস্যা, সংকট এবং সম্ভাবনা নিয়ে অবশ্যই ভেবেছেন এবং নিজেকে কীভাবে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া যায় তা নিয়ে একটি ছকও তৈরি করে ফেলেছেন। জেলখানায় আপনার উচিত হবে প্রতিটি মুহূর্তের নিঃসঙ্গতা যেন আপনার ধারেকাছেও ঘেঁষতে না পারে। অনেক চিন্তাভাবনার পর আপনি ঠিক করলেন সকাল থেকে রাত অবধি আপনার করণীয় সম্পর্কে এবং সেভাবেই পার করতে থাকলেন একেকটি দিন।
আপনি যদি ধার্মিক হন তবে খুব ভোরে অর্থাৎ ৫টার সময় ঘুম থেকে উঠে অজু করবেন, আপনার সেবককেও ডাকবেন নামাজের জন্য। এরপর আপনি ইমামতি করে নামাজ অদায় করবেন। চারদিকে তখনো আবছা অন্ধকার। নীরব ও নিস্তব্ধ পরিবেশ বিরাজ করছে। আপনার রুমের লকআপ তখনো খোলেনি। নিজেকে যাতে প্রতি মুহূর্তে একজন কারাবন্দী হিসেবে ভাবতে পারেন সে জন্য সব ব্যবস্থাই কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করেছে। এ নিয়ে এখন আর আপনার মন খারাপ হয় না। আপনার সেবকটিও আপনার মতো একই দুঃখে দুঃখী। আপনারা দুজন একসঙ্গে আল্লাহর দরবারে হাত তুলবেন। আপনার ভাষাজ্ঞান এবং ইসলাম সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা থাকার কারণে মোনাজাত হবে হৃদয়গ্রাহী, আবেগপ্রবণ এবং প্রাণের প্রণতি মেশানো। আপনি অনুভব করতে পারবেন আপনার রব আপনার থেকে খুব দূরে নন। সেই মুহূর্তে আপনি অনুভবের জায়গায় পেঁৗছে ভাবতে শুরু করবেন স্বয়ং আল্লাহ তার রহমতসহ আপনার ঠিক ঘাড়ের কাছে উপস্থিত, তখন মনের সব আকুতি অশ্রু হয়ে ঝর ঝর করে পড়তে থাকবে। আপনার সরল সোজা সেবকও আপনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাঁদতে কাঁদতে অস্থির হয়ে পড়বে। পরম প্রশান্তি নিয়ে আপনি মোনাজাত শেষ করে আবার একটু ঘুমিয়ে নেবেন। নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নেবেন সকাল ৭টার সময় বিছানা ত্যাগ করার।৭টার সময় ঘুম থেকে জেগে আপনি তাড়াতাড়ি অজু করে নেবেন। কারণ জাগ্রত অবস্থায় আপনি অজু করে পূত-পবিত্র থাকার অভ্যাসটি দীর্ঘদিন ধরে গড়ে তুলেছেন। কিছু তসবি-তাহলিল, দোয়া-দরুদ আপনি সব সময়ই পাঠ করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন কৈশোর বয়স থেকেই হাঁটতে, চলতে, কাজ করতে কিংবা দীর্ঘ ভ্রমণে আপনি এমনটি করেই সময় কাটাতে পছন্দ করেন। এবার তাড়াহুড়া করে ব্যায়ামের পোশাক পরবেন, সঙ্গে কেটসও। রুম থেকে বের হওয়ার আগে আপনি একটি বিস্কুট মুখে দিয়ে দুই গ্লাস পানি পান করে নিচে নামবেন এবং টানা পৌনে এক ঘণ্টা হাঁটার পর আপনার ঘাম ঝরতে শুরু করবে। হাঁটার সময় আপনি আপনার প্রিয় তসবিটি জপতে থাকবেন। এ সময় আপনি সঙ্গী হিসেবে পাবেন অনেক শালিক। সকালে যে বন্দীটি রাস্তা ঝাড়ু দিতে আসে তার সঙ্গে আপনার অত্যন্ত সৌহার্দ্য পরিবেশে সালাম বিনিময় হবে। প্রায় ৬০ বছর বয়সী লোকটি কোনো দিকে না তাকিয়ে এবং কারও সঙ্গে একটি কথা না বলেও টানা দেড় ঘণ্টা ধরে পুরো রাস্তা এবং এর লাগোয়া বাগান ও মাঠের ওপর পড়ে থাকা ঝরাপাতা ও অন্যান্য ময়লা ঝাড়ু দিতে থাকবে। আপনি অবাক হয়ে তার কর্মদক্ষতা দেখবেন এবং মনে মনে তার জন্য দোয়া করবেন। কোনো কথা বিনিময় না হওয়ার পরও আপনাদের মধ্যে ভাব হয়ে যাবে।
এরপর আপনি ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে রুমের সামনে টানা লম্বা বেলকনিতে এসে দাঁড়াবেন। আপনার সেবক সঙ্গে সঙ্গে আপনার জন্য একটি চেয়ার নিয়ে আসবে। ঘর্মাক্ত শরীরে আপনি বসার পর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখবেন সকাল ৮টা বেজে গেছে। সেবক আপনাকে পরপর দুই গ্লাস ঠাণ্ডা পানি দেবে পান করার জন্য। আপনি এ সময় সাধারণত দুই গ্লাস পানি খান। কিন্তু বেশি ঘাম ঝরলে কখনো কখনো তিন গ্লাসও খেয়ে থাকেন। এরপর আপনি গেঞ্জি ও কেডস খুলে ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই দেখবেন সেবক স্যান্ডেল ও গামছা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আপনি আবার বসবেন এবং গামছাটি দিয়ে শরীর ও মুখের ঘাম মুছতে থাকবেন। এভাবে হয়তো দু-তিন মিনিট যাবে। আপনি ঘাম মুছতে মুছতে প্রকৃতির বাতাসে শরীর ঠাণ্ডা করবেন এবং সামনের বাগানের হৃষ্টপুষ্ট গাছগুলোর সবুজ পাতা ও ডালপালার নড়াচড়া দেখতে থাকবেন। এমন সময় সেবক আপনাকে বড় এক কাপ মজাদার গরম পানীয় এনে দেবে। চকোলেট, হরলিকস, দুধ এবং দুই চামচ মধুর সমন্বয়ে মজাদার পানীয়টি বানানোর কৌশল আপনি শুধু তাকে এক দিনই দেখিয়ে দিয়েছেন। ব্যস! এর পর থেকে সে আপনার চেয়েও জিনিসটি ভালোভাবে প্রস্তুত করতে শিখেছে। আপনি চমৎকার একটি মুডে হরলিকসের কাপে চুমুক দিতে যাবেন অমনি সময় সেবক আপনার কাছে সেই বইটি এনে দেবে যা কি না আপনি ধারাবাহিকভাবে কয়েক দিন ধরে পড়ছেন। প্রায় ১৫ মিনিট ধরে আপনি বই পড়বেন, মাঝেমধ্যে গাছ, মাটি, পাখি ও আকাশ দেখবেন এবং মনের সুখে বিশেষ পানীয়টি পান করবেন।
এরই মধ্যে সেবক আপনার সিগারেটের প্যাকেট, অ্যাশট্রে এবং লাইটার রেখে যাবে। আপনি অবশ্য অনেক আগেই ধূমপান ছেড়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু অখণ্ড অবসরে আপনার ওইটির পুনরায় প্রয়োজন দেখা দিল, আপনার জেল পার্টনারের কারণে। সে সিগারেটে অভ্যস্ত এবং আপনার সামনে যখন ধূমপান করে তখন আপনার খুব ইচ্ছা হয় তার মতো ধোঁয়া তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে এরপর তা ছেড়ে দিতে। আপনার স্ত্রীর কাছে এ কথা বলতেই সে আপনাকে এক কার্টন ইংল্যান্ডের তৈরি গুরলান ব্র্যান্ডের মেনথলমুক্ত স্লিম সিগারেট কিনে দিয়ে গেল। প্রথম দু-তিন দিন আপনার সিগারেট টানতে গিয়ে বেশ কষ্ট হলো। এরপর আপনি হয়ে গেলেন একজন নিয়মিত ধূমপায়ী। যেহেতু আপনি ধূমপানের খারাপ দিকগুলো সম্পর্কে সচেতন সেহেতু সকাল-বিকাল মিলে দু-তিনটির বেশি গ্রহণ করবেন না। সিগারেটে টান দিতে দিতে একবার হয়তো বইয়ের দিকে নজর দেবেন আবার হয়তো আকাশের দিকে। কখনো কখনো সামনের গাছপালার দিকে। আপনার ভাগ্য ভালো হলে দু-চারটি হলদে পাখি কিংবা কুটুম পাখির দেখাও পেয়ে যেতে পারেন। হঠাৎ আনমনে আপনার মাথায় প্রশ্ন আসবে, জেলখানায় কেন একটাও কুকুর দেখতে পেলেন না কিংবা ঢাকা শহর বা অন্যান্য এলাকার মতো কাকের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। এসব চিন্তা করতে করতে আপনার সিগারেট শেষ হয়ে যাবে এবং আপনি পেটের মধ্যে একটু হালকা বেদনাসহ দুমড়ানি-মুচড়ানি অনুভব করছেন। আপনি টয়লেটে যাওয়ার আগে অবশ্যই ঘড়ির দিকে নজর দেবেন এবং লক্ষ্য করবেন সকাল সাড়ে ৮টা বেজে গেছে।আপনি যখন মুক্ত ছিলেন তখন বাথরুমে গিয়ে পত্রিকা পড়া ছিল আপনার নিত্যকার অভ্যাস। সকাল ৮টার দিকে বাসায় পত্রিকাগুলো পেঁৗছার পর আপনি সেগুলো নিয়ে বাথরুমে ঢুকতেন এবং ৩০ থেকে ৩৫ মিনিট পর্যন্ত সময় ব্যয় করতেন। এতে আপনার স্ত্রীর অভিযোগের সীমা-পরিসীমা ছিল না। কিন্তু যেদিন আপনি তাকে জানালেন যে সাবেক রাষ্ট্রপতি জনাব এরশাদ, সাবেক মন্ত্রী জনাব তোফায়েল আহমেদসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তিই একই কর্ম করেন সেদিন থেকে স্ত্রী মহোদয়া তার অভিযোগের বর্ষণ বন্ধ করল। জেলখানায় সাধারণত পত্রিকা আসে বেলা ১১টার পরে। সেহেতু আপনি কেবল বাথরুমে গিয়ে পড়ার জন্য একটি মজাদার হালকা মেজাজের রসাত্দক উপন্যাস বাছাই করে ফেলেছেন। সব কিছু সেরে বাথরুমের বাইরে আসার পর দেখলেন সকাল সোয়া ৯টা বেজে গেছে।
সকালের নাস্তা আপনারা সবাই মিলে অর্থাৎ এই সেলের অন্য চার বন্দীসহ একসঙ্গে করেন পৌনে ১০টা থেকে ১০টার মধ্যে। নাস্তা একটু দেরিতে হয় কেবল জনাব গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের জন্য। তিনি রাতে ঘুমাতে যান বেশ দেরিতে আবার জাগেনও দেরি করে। আপনারা সবাই এই দেরিটুকু সানন্দচিত্তে মেনে নিয়েছেন এ কারণে যে মামুন সাহেব আপন-পর নির্বিশেষে আপনাদের জন্য অনেক কিছু করেন। জেলজীবনে প্রতিদিন বাহারি খাবার নাস্তা-পানিসহ নানা রকম আয়োজনের মাধ্যমে সে আপনাদের কষ্ট লাঘব করার আপ্রাণ চেষ্টা করে নিজের পকেটের পয়সা ব্যয় করে। ফলে খাবার টেবিলে তার অনুপস্থিতি আপনাদের কল্পনাই করা উচিত নয়। নাস্তার টেবিলে খাবার জন্য এখনো আপনার হাতে আধা ঘণ্টার মতো সময় আছে। আপনি চেয়ার টেনে পশ্চিমমুখো হয়ে পড়ার টেবিলটির সামনে বসবেন। এরপর চোখ বুজে কোরআন শরিফ বুকে চেপে ধরবেন। এখন আপনি গভীর ধ্যান এবং প্রাণের সব আকুতি উজাড় করে দিয়ে আপনার সৃষ্টিকর্তা মহান রব আল্লাহর সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করবেন অনেকটা প্রার্থনার কায়দায়। আপনার আবেগ, ভাবাবেগ, ভাষার গাঁথুনি, প্রকাশভঙ্গি এবং বিষয়বস্তু সব কিছু চোখের জলে একাকার হয়ে যাবে। বিশ্বাস ও ভালোবাসার আকুতিতে আপনি এক মহাজাগতিক শক্তির স্পর্শ অনুভব করতে থাকবেন। এমন সময় আপনার সেবক পেছনে দাঁড়িয়ে মৃদু ও মোলায়েম সুরে কেবল উচ্চারণ করবে স্যার! আপনি বুঝবেন এরই মধ্যে ৩০ মিনিট পার হয়ে গেছে। নাস্তার টেবিলে সবাই অপেক্ষা করছে।
দোতলায় আপনার রুম থেকে ধীরলয়ে এবং প্রশান্তচিত্তে তিন তলায় মামুন সাহেবের সামনে স্থাপিত অস্থায়ী ডাইনিং টেবিলে খাবার আসার আগে আপনার পুনরায় দরকার পড়বে চোখে-মুখে পানির ঝাপটা মারার এবং মাথা অাঁচড়ানোর। টেবিলের দক্ষিণ পাশে আপনার জন্য নির্ধারিত চেয়ারে বসে আপনি লক্ষ্য করবেন আপনার সেবকসহ আরও ছয়-সাত জন সেবক দাঁড়িয়ে রয়েছে বাইরে নাস্তা পরিবেশন করার জন্য। জেল কর্তৃপক্ষের সামান্য এবং নির্ধারিত আয়োজনের সঙ্গে আপনারা ভাগাভাগি করে বেশ কিছু আইটেম সংগ্রহ করেছেন। তবে অনেক কিছুই মামুন সাহেব কিনে আনেন বা তার বাসা থেকে আসে প্রতি সপ্তাহে। টেবিলে আপনি দেখতে পাবেন আমেরিকান কায়দায় জ্যাম, জেলি, বাটার, চিজসহ টোস্ট করা পাউরুটি। এ ছাড়াও ডিম, ভাজি, সাদা ও লাল আটার তৈরি ছোট ছোট নরম রুটি, আরও আছে- দুধ, চিনি ও কর্নফ্লেঙ্। তবে নাস্তা শুরুর আগে আপনাদের এক জেলমেটের পরামর্শ অনুযায়ী সবাই এক টুকরো করে পাকা পেঁপে খাবেন। নাস্তার টেবিলে সাজানো আইটেমগুলোর মধ্যে আপনি কোনটা খাবেন কিংবা খাবেন না অথবা কতটুকু পরিমাণ গ্রহণ করবেন তা সেবকরা এরই মধ্যে জেনে গেছে। সেবকদের সরদার মতি মিয়া আপনার পছন্দের নাস্তার আইটেমগুলো পরিবেশন করতে থাকবে। সবার শেষে আসবে চা বা কফি এবং তা অবশ্যই আপনাদের পছন্দমতো বা ফরমায়েশ মতো বানানো থাকবে।নাস্তার টেবিলে আপনারা সাধারণত এক থেকে দেড় ঘণ্টা ব্যয় করেন। খেতে খেতে আলোচনা করতে থাকেন দেশ-বিদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, নৃতত্ত্ব, মহাকাশ বিজ্ঞান কিংবা উত্তর মেরু, দক্ষিণ মেরু ও গ্রিনল্যান্ডের আইসবার্গ বা বরফের স্তূপ সম্পর্কে। আলোচনা করেন চলচ্চিত্র, নাটক এবং আপনাদের পরিচিত অনেক নামকরা মানুষের জীবনের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে। বিশেষত এর আগে যারা জেল খেটেছেন তাদের অনেকের সঙ্গেই মামুন সাহেবের একত্রে থাকার সুযোগ হয়েছিল। সেসব দিনের চমৎকার সব অজানা তথ্য শুনে আপনার সঙ্গী-সাথীরা চমকিত হয়ে উঠবেন। মাঝেমধ্যে আদি রসাত্দক গল্প-গুজবও চলতে থাকবে। এখানে সবাই সাধারণত ভুলেও একে অন্যকে খোঁটা দিয়ে কথা বলে না। এমন কথা বলে যাতে গোটা পরিবেশটি হয়ে ওঠে উপভোগ্য, আনন্দময় এবং একই সঙ্গে শিক্ষামূলক। আর হ্যাঁ, আলোচনার একটি বিরাট অংশই কিন্তু থাকে রাজনীতিসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে। যে ভুল করে আপনি জেলখানায় এসেছেন সে একই ভুল অবশ্যই আপনি নাস্তার টেবিলে করতে যাবেন না!নাস্তা শেষে রুমে ফিরে আপনি ইচ্ছা করলে আরও একটি সিগারেট টানতে পারেন বা কিছু সময়ের জন্য বাথরুমেও কাটিয়ে আসতে পারেন। আপনার হাতে সময় খুব অল্প। কারণ এর পরই আপনি লিখতে বসবেন। কারাগার ও সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে কিছু একটা লেখার চেষ্টা করছেন প্রতিদিনই। সাধারণত আপনি এই সময় এবং রাতে কিছু সময় ধরে লিখতে থাকেন। কোনো দিন হয়তো বা সাকল্যে এক হাজার শব্দ লেখা হয়। আবার কোনো কোনো দিন এমনও গেছে যে আপনি ফটাফট তিন হাজার শব্দ লিখে ফেলেছেন। কাগজ-কলম নিয়ে বসার পর আপনি টানা দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত লিখবেন। এরপর আবার কিছুটা সময় কোরআন শরিফ পড়বেন হয়তো ৩০ বা ৩৫ মিনিট। এরপর সোয়া ১টার সময় আবার তিন তলায় মামুন সাহেবের রুমে গিয়ে জোহরের নামাজ এবং দুপুরের খাবার।
দুপুরের খাবারের টেবিলে প্রায়ই লঙ্কাকাণ্ড ঘটে থাকে। প্রতি শুক্রবার ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দীদের পরিবার-পরিজন আসে দেখা-সাক্ষাতের জন্য। সঙ্গে আনে বাসা থেকে রান্না করা আপনাদের সব পছন্দের খাবার। বাইরে থাকতে এসব খাবার কালেভদ্রে খেতে পারতেন যদি পরিবারের প্রিয় মেহমান বেড়াতে আসত। কিন্তু কেবল আপনার জন্য এসব রান্নার ঝামেলা বিবাহিত জীবনে কতবার হয়েছে তা আর এখন আপনার মনে নেই। তবে কারাগারে আসার পর আপনি যেমন পরিবারের গুরুত্ব অনুভব করছেন হাড়ে হাড়ে, তেমনি পরিবারও আপনাকে মনে করছে প্রতি মুহূর্তে। ফলে শুক্রবার আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসার আগের দুই দিন তাদের অনেক কষ্ট করতে হয়। বুধবার হয়তো বাজার করেন। এরপর পুরো বৃহস্পতিবার দিন থেকে রাত অবধি চলে রান্না। এগুলো ঠাণ্ডা করে ফ্রিজে রাখা এবং শুক্রবার খুব সকালে উঠে প্রতিটি খাবার পুনরায় গরম করে হটপটে ঢোকানো- সবশেষে সকাল ৭টার মধ্যেই ঢাকা থেকে রওনা হয়ে ঠিক ১০টায় গাজীপুরের কোনাবাড়ীর কাশিমপুর কারাগারে পেঁৗছা চাট্টিখানি কথা নয়। ওই দিন আপনার জন্য পুরো পরিবার সকালে এবং দুপুরে ঠিকমতো খেতে পারে না।
আপনারা শুক্রবারের সব খাবার-দাবার জমা করেন মামুন সাহেবের রুমে। এরপর এগুলো কারাগারের রান্নাঘরের একটি ফ্রিজে রেখে দেওয়া হয়। প্রতিদিনের ফরমায়েশ অনুসারে এখানকার সাধারণ খাবারের সঙ্গে ওইসব খাবারের দু-তিনটি পদ যোগ হয়। একেক দিন একেকজনের বাসার খাবার। যেদিন আপনার খাবার পরিবেশন করা হয় সেদিন অন্য সবাই সমস্বরে আপনার স্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাবে এবং তার রান্নার ভূয়সী প্রশংসা করবে যেমনটি আপনিও করে থাকেন অন্য বাসা থেকে আনীত খাবার পরিবেশিত হলে। লোকজন যখন আপনার স্ত্রীর রান্নার প্রশংসায় মত্ত হয়ে ওঠে তখন আপনিও মনের আনন্দে হাসতে থাকেন। কিন্তু সেই হাসির ফাঁকে এক অদৃশ্য কান্না লুকায়িত থাকে। হাসতে হাসতে আপনি খেতে থাকবেন এবং আপনার চোখ ঝাপসা হয়ে আসবে স্ত্রীর কথা মনে করে। কোনো এক ফাঁকে দু-এক ফোঁটা অশ্রুও আপনার চোখ থেকে পড়ে যাবে। আপনি তা লুকানোর চেষ্টা করবেন ঝাল বা অন্য কোনো কথা বলে। আপনার সঙ্গীরা সব টের পাবে। কিন্তু নিতান্ত সহমর্মিতার কারণে এতটুকু প্রতারণা মেনে নেবে। খাবার পর্ব শেষ হওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ আবার গল্প-স্বল্প। এরপর আপনি উঠে আসবেন, কেননা দুপুরে কিছু সময়ের জন্য আপনাকে ঘুমাতে হবে। ঘুম থেকে ওঠার পর দেখবেন বিকাল ৪টা বেজে গেছে। সাড়ে ৪টার মধ্যে আপনি আসরের নামাজ পড়বেন। এরপর জগিং স্যুট পরে বৈকালিক শরীরচর্চার জন্য নিচে নামবেন। সূর্য তখন পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছে এবং কিছুটা উত্তাপ তখনো রয়ে গেছে। কিন্তু কোনো উত্তাপই আপনার গায়ে লাগবে না। কারণ অনেক বৃক্ষের ছায়া পুরো ওয়াকওয়েটিকে আবৃত করে রেখেছে। সেলের বাইরের রাস্তায় তখন সাধারণ বন্দীদের কোলাহল চলছে। বন্দীরা দল বেঁধে গল্প করছে আর হাঁটছে। আপনি যখন জগিং করতে করতে মূল ফটকের কাছাকাছি যাবেন তখন রাস্তায় চলাচলকারী বন্দীরা অবাক বিস্ময়ে আপনার দিকে তাকাবে। তারা মনে হয় জেলখানার ডিভিশন সেলের ওয়াকওয়েতে এর আগে কাউকে আপনার মতো সকাল-বিকাল দৌড়াতে দেখেনি। এই আশ্চর্য ঘটনা দেখার পর তারা কারারক্ষীদের কাছে আপনার বিষয়ে জানতে চাইবে। আপনি এসব গোপন আলাপের কিছুই শুনতে পাবেন না। কেউ কেউ উঁকি দিয়ে আপনাকে দেখার সময় চোখাচোখি হলে সুন্দর করে একটি সালাম দেবে।
আপনি যখন দৌড়াতে থাকবেন তখন সেলের অন্যান্য ভিআইপি বন্দী মাঠের মধ্যে যে বিশাল পানির রিজার্ভার ট্যাংকটি রয়েছে তার ওপর বসে বৈকালিক আলাপে মত্ত হবে। আপনি তাদের দিকে দু-একবার তাকালে তারা হাত উঁচিয়ে আপনাকে শুভেচ্ছা জানাবে। আপনি মাঠের দিকে তাকালে দেখবেন অনেক শালিক দল বেঁধে ডিনার করছে। ডিনার মানে রাতের খাবার। পাখিরা রাতের খাবার বিকালের মধ্যেই সেরে ফেলে এবং সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজের নীড়ে ফিরে যায়। বিকাল বেলার জগিং সকালের তুলনায় একটু নিরাপদ। কারণ এ সময় আপনি ইচ্ছা করলে ঘন ঘন আকাশের দিকে তাকাতে পারবেন। অথচ সকালে বেশির ভাগ সময় জমিনের দিকে তাকিয়ে দৌড়াতে বা হাঁটতে হয়। কারণ অনেক কেঁচো প্রায়ই রাস্তার এপার থেকে ওপার চলাচল করে। সারি সারি বিমান আকৃতির কালো রংয়ের পিঁপড়া যাদের ছোট কালো ওল্লা বলে জানতেন। তারাও কী কারণে যেন আপনার মতো জগিং করতে থাকে। আপনার অসতর্ক পদভারে তাদের প্রাণনাশ হতে পারে_ এই ভয়ে আপনাকে তখন সতর্কতার সঙ্গে পা ফেলতে হয়।
জগিং শেষে আপনি সকালের মতো পুনরায় বেলকনিতে বসে টানা ৩০ মিনিট শরীর ঠাণ্ডা করবেন। এ সময় সেবক আপনার সামনে এসে দাঁড়াবে। আপনি চা, কফি বা হরলিকস মিশ্রিত গরম দুধের যে কোনো একটি বানানোর জন্য বলবেন। সঙ্গে সিগারেটও চলতে পারে। এরপর ঠিক ৬টার সময় আপনি বাথরুমে ঢুকবেন গোসল করার জন্য। সেখান থেকে বের হয়ে দেখবেন আরও কিছুটা সময় আছে মাগরিবের নামাজের। সময়টুকু ইবাদত কবুলের জন্য উৎকৃষ্ট হওয়ার কারণে আপনি কেবলামুখী হয়ে সুন্দর একটি মোনাজাত করবেন। এরপর তিন তলায় যাবেন জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করার জন্য।
মাগরিবের পর হালকা নাস্তার আয়োজন হয়। কখনো বাইরের আবার কখনো ভেতরের বানানো। পুরি, মোগলাই, বুট-মুড়ি, পিয়াজু, কাবাব, নুডুলস ইত্যাদি যে কোনো আইটেম একেকটির আয়োজন থাকে একেক দিন। এর ফাঁকে গল্পগুজব। রেডিওর খবর শুনতে শুনতে পৌনে ৮টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে ইশার নামাজ। এরপর নিজ নিজ রুমে ফিরলে কারারক্ষীরা এসে আপনার রুম বাইরে থেকে তালা মেরে দেবে।
আপনি সাড়ে ৮টার মধ্যে রাতের খাবার খাবেন। এরপর কিছু ভিটামিন এবং ওমেগা-৩ সাপ্লিমেন্ট ওষুধ ও ইসুবগুলের ভুসি খাওয়ার পর দাঁত ব্রাশ। এখন ঘণ্টাখানেক আবার লেখালেখি এরপর ঘুমানোর আগে কোরআন তিলাওয়াত। আপনার তিলাওয়াত শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেবক মশারি টানিয়ে ফেলবে। টিভির ভলিউম একদম কমিয়ে দেবে। তিলাওয়াতে আপনি ৩০ মিনিট সময় ব্যয় করবেন এবং সব শেষে ঘুমানোর জন্য মশারির মধ্যে ঢুকে কাত হয়ে শুয়ে থাকবেন। আপনার সেবক সব লাইট বন্ধ করে কেবল টিভিটি চালিয়ে রাখবে শব্দহীন করে। এরপর আপনার বিছানার কাছে এসে সুন্দর করে পা টিপতে থাকবে। এরপর পিঠ, ঘাড়, হাত। কতক্ষণ ধরে সে অমূল্য সেবা দেবে তা আপনার অজানাই থেকে যাবে। কারণ টিপতে টিপতে একসময় সে আপনার মাথার চুলে বিলি কাটতে থাকবে। সারা দিনের সব কিছু ভুলে চুলের মধ্যে বিলি কাটার আবেশে আপনি কখন যে ঘুমিয়ে পড়বেন তা টেরই পাবেন না।
Post a Comment