MYSTERIOUS CITY SIMBEL
posted Aug 31, 2013, 1:59 PM by hasan ali
রহস্যময় শহর আবু সিম্বেল
বিশ্ব ইতিহাসে মিশর একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। নীল নদ ও পিরামিড বেষ্টিত মিশর সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের সূতিকাগার। বিশ্ব সভ্যতার অনেক নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সমগ্র মিশর জুড়ে। নীল নদ ও পিরামিড ছাড়াও মিশরের আরও একটি ঐতিহাসিক স্থানের নাম আবু সিম্বেল। আবু সিম্বেল মিশরের দক্ষিণাংশে অবস্থিত একটি পুরাতাত্ত্বিক স্থাপনা, যা দুইটি বিশাল পাথর-নির্মিত মন্দির নিয়ে গঠিত। এটি আসওয়ান এর ২৯০ কিমি দক্ষিণ-পশ্চিমে লেক নাসের এর পাড়ে অবস্থিত।
এই স্থাপনাটিকে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসাবে ঘোষণা করেছে। আবু সিম্বেল সহ সম্পূর্ণ এলাকাটি নুবিয়ান মনুমেন্টস নামেও খ্যাত।
খ্রিস্টপূর্ব ১৩শ শতকে ফারাও ২য় রামসেসের আমলে তাঁর ও তার রাণী নেফারতারির সম্মানে ও কাদেশের যুদ্ধ এর স্মৃতি রক্ষার্থে পাহাড়ের ঘা ঘেঁষে মন্দির দুটি নির্মাণ করা হয়। বিংশ শতকে ১৯৬০ এর দশকে মন্দির দুটিকে সম্পূর্ণভাবে স্থানান্তর করা হয়, কেননা ঐ সময় নীল নদের উপরে আসওয়ান বাঁধ তৈরিতে সৃষ্ট লেক নাসের মন্দির দুটির পূর্বের এলাকাকে গ্রাস করে নেয়া শুরু করে। বর্তমানে স্থাপনাটি আসওয়ান বাঁধ এলাকার অনেক উপরে একটি কৃত্রিম পাহাড়ের উপরে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। বর্তমানে আবু সিম্বেল মিশরের অন্যতম একটি পর্যটন কেন্দ্র। প্রতি বছর হাজার হাজার লোক এই স্থানটি দর্শন করতে আসে।
আবু সিম্বেলের মন্দির নির্মাণ শুরু হয় আনুমানিক ১২৪৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, এবং পরের ২০ বছর ধরে তা অব্যাহত থাকে। ২য় রামসেসের আমলে নুবিয়াতে যে ছয়টি পাথরের মন্দির তৈরি করা হয়েছিল এটি ছিলো তার মধ্যে একটি অন্যতম। সময়ের সাথে সাথে দীর্ঘ দিন পর মন্দিরটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে এবং ধীরে ধীরে এটি বালির তলায় চাপা পড়ে যায়। ৬ষ্ট খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ মূল মন্দিরটির মূর্তিগুলির হাঁটু পর্যন্ত বালুর তলায় চলে যায়। মন্দিরটির কথা আস্তে আস্তে সবাই ভুলে যায়। ১৮১৩ সালে সুইস প্রাচ্য বিশেষজ্ঞ ইয়োহান লুডভিগ বার্কহার্ড মন্দিরের উপরের অংশ খুঁজে পান। এই আবিষ্কারের কথা তিনি ইতালীয় পরিব্রাজক জিওভান্নি বাতিস্তা বেলজোনিকে জানান। বেলজোনি মন্দির এলাকায় যান, কিন্তু মন্দিরে ঢোকার পথটি খুঁজে পাননি। ১৮১৭ সালে বেলজোনি ফিরে আসেন এবং এই বার মন্দির এলাকায় প্রবেশের পথ বের করেন। তিনি মন্দির এলাকায় মূল্যবান সব ধনসম্পদ লুটে নেন।
এই স্থানটির নাম “আবু সিম্বেল” হওয়ার পিছনে রয়েছে একটি কাহিনী। আবু সিম্বেল ছিলো ঐ এলাকার এক বালকের নাম, যে ঊন-বিংশ শতকের অভিযাত্রীদের পথ প্রদর্শক হিসাবে কাজ করতো। বালুর নিচে হারিয়ে যাওয়া মন্দিরটির অবস্থান এই বালক সবচেয়ে ভালো করে জানতো। তাই এক সময় অভিযাত্রীরা মন্দির এলাকাটিকে এই বালকের নামানুসারে “আবু সিম্বেল” নামকরণ করেন।
১৯৫৯ সালে নুবিয়ার পুরাকীর্তিসমূহকে রক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা শুরু হয়। আসওয়ান বাঁধ নির্মাণের ফলে সৃষ্ট লেক নাসের এর পানির তলায় এই পুরাকীর্তিগুলো তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিলো। আবু সিম্বেলের মন্দিরগুলো রক্ষার কাজ শুরু হয় ১৯৬৪ সালে। প্রায় ৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচে ১৯৬৪ হতে ১৯৬৮ সালের মধ্যে এই মন্দিরগুলোকে উঁচু স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়। এজন্য পুরো মন্দির এলাকার সব স্থাপনাকে বড় বড় টুকরা করে কেটে আলাদা করে নীল নদের বর্ধমান তীর হতে ২০০ মিটার দূরে ও প্রায় ৬৫ মিটার উচ্চ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়। সফলভাবে মন্দির স্থাপনাকে স্থানান্তর করার এই প্রকল্পকে পুরাতাত্ত্বিক প্রকৌশলের সেরা সাফল্যগুলোর মধ্যে গণ্য করা হয়।
মন্দির স্থাপনাতে দুইটি মন্দির রয়েছে। এদের মধ্যে বড়টি মিশরের তদানীন্তন প্রধান তিন উপাস্য দেবতা রা হারখতি, প্তাহ, এবং আমুন এর উদ্দেশ্যে নিবেদিত। এই মন্দিরটিতে রামসেসের চারটি বড় মূর্তি রয়েছে। ছোট মন্দিরটি দেবী হাথর এর উদ্দেশ্যে নিবেদিত। হাথরের প্রতিমূর্তি হিসাবে রামসেসের প্রিয় স্ত্রী নেফেরতারির মূর্তি এই মন্দিরে শোভা পাচ্ছে।
আবু সিম্বেলের বৃহত্তর মন্দিরটি তৈরি করতে সময় লেগেছিলো ২০ বছর। ফারাও মহান রামসেসের রাজত্বের ২৪তম বছরে ১২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়। আমুন রা, রা-হোরাখতি, এবং পতাহ দেবতা, এবং রামসেসের উদ্দেশ্যে এই মন্দিরটি উৎসর্গ করা হয়। রামসেসের রাজত্বকালে নির্মিত মন্দিরসমূহের মধ্যে এটিকেই সবচেয়ে সুন্দর ও রাজকীয় বলে গণ্য করা হয়। উচ্চ ও নিম্ন মিশরের দ্বৈত মুকুট খচিত ফারাও রামসেসের ২০ মিটার উঁচু চারটি মূর্তি মন্দির এলাকায় অবস্থিত। মন্দির এলাকাটি ৩৫ মিটার প্রশস্ত। সবার উপরে সূর্যের উপাসক ২২টি বেবুনের মূর্তি প্রবেশপথকে ঘিরে রেখেছে। ফারাওয়ের এই বিশালাকার মূর্তিগুলো যে পাহাড় কেটে মন্দির তৈরি হয়েছিলো, সেই পাহাড়ের পাথর কেটেই নির্মাণ করা হয়েছে। সবগুলো মূর্তি সিংহাসনে বসে থাকা রামসেসের প্রতিনিধিত্ব করছে। প্রবেশপথের বাম দিকের মূর্তিটি একটি ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বর্তমানে কেবল মূর্তিটির নিচের অংশ অক্ষত রয়েছে। এর সামনেই ভেঙে পড়া মূর্তির মাথা ও দেহ পড়ে রয়েছে। ফারাওয়ের বড় মূর্তিগুলোর পাশেই রয়েছে ছোট ছোট কিছু মূর্তি, যাদের উচ্চতা ফারাওয়ের হাঁটুর চেয়ে কম। এগুলো রামসেসের প্রধান স্ত্রী নেফারতারি, এবং রাজমাতা রাণী মুত-তুই, রামসেসের প্রথম দুই পুত্র আমুন-হের-খেপেশেফ ও রামসেস বি, এবং ফারাওয়ের প্রথম ছয় কন্যা বিন্তানাথ, বেকেতমুত, নেফেরতারি, মেরিতামেন, নেবেত্তাউই, এবং ইসেত্নোফ্রেত এর মূর্তি।
প্রবেশদ্বারটিতে রয়েছে বাজপাখির মতো মাথাবিশিষ্ট দেবতা রা হারাখতিকে উপাসনারত ফারাও রামসেসের ছবি। মন্দিরের ভিতরে প্রাচীন মিশরের অন্যান্য মন্দিরের মতোই ত্রিকোণাকার কাঠামো ব্যবহার করা হয়েছে, যাতে কক্ষগুলোর আকার প্রবেশ পথ থেকে মূল শব কক্ষ পর্যন্ত আস্তে আস্তে কমতে থাকে। মন্দির অঙ্গনের গঠন বেশ জটিল ও বহু পার্শ্ব কক্ষবিশিষ্ট। প্রোনাস বা হাইপোস্টাইল হল হলো ১৮ মিটার দীর্ঘ ও ১৬.৭ মিটার প্রশস্ত, এবং আটটি প্রকাণ্ড মূর্তি সদৃশ স্তম্ভ বিশিষ্ট। এই স্তম্ভগুলোতে পর জগতের দেবতা অসিরিস এর চেহারা খোদাই করা, যা ফারাও এর অমরত্বের প্রতীক। বাম দিকের দেয়ালের কাছের বড় মূর্তিগুলো ঊর্ধ্ব মিশরের সাদা মুকুট খচিত, আর ডান দিকের মূর্তিগুলো নিম্ন মিশরের দ্বৈত মুকুট পরে আছে। প্রোনাস হলের দেয়ালচিত্রগুলো ফারাওয়ের বিভিন্ন সামরিক অভিযানের উপরে অঙ্কিত। অধিকাংশ ছবিতেই প্রকাশ পেয়েছে কাদেশের যুদ্ধের কথা, সিরিয়ার ওরন্তেস নদীর পারে যেখানে মিশরের ফারাও হিট্টীয় বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করেছিলেন। সবচেয়ে বিখ্যাত চিত্রটিতে দেখানো হয়েছে, ফারাও তাঁর রথে বসে পলায়নোদ্যত শত্রুদের দিকে তীর নিক্ষেপ করছেন। অন্য ছবিতে লিবিয়া ও নুবিয়ার সাথে যুদ্ধে মিশরের বিজয় দেখানো হয়েছে।
আবু সিম্বেল মন্দির এলাকায় অবস্থিত হাথর ও নেফারতারির মন্দিরটি মূল রামসেসের বৃহত্তর মন্দির হতে প্রায় ১০০ মিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। এটি দেবী হাথর, এবং ২য় রামসেসের প্রধান স্ত্রী নেফারতারির উদ্দেশ্যে নিবেদিত। রাণীর উদ্দেশ্যে মন্দির উৎসর্গ করার এই ঘটনাটি মিশরের ইতিহাসে দ্বিতীয়। এর আগে আখনাতেন তাঁর স্ত্রী নেফারতিতির উদ্দেশ্যে মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। মন্দিরটির সম্মুখভাগের দেয়াল পাথর খোদাই করে নির্মিত। দুই পাশে রয়েছে দুই গুচ্ছ মূর্তি, আর তাদের মাঝে রয়েছে বৃহৎ প্রবেশদ্বার। মূর্তিগুলো প্রায় ১০ মিটার উঁচু। এগুলো ফারাও ও রাণীর মূর্তি।
প্রবেশ দ্বারের অন্য পাশে রয়েছে ফারাওয়ের দুইটি মূর্তি। রাণী ও রাজার আরও কয়েকটি মূর্তি দিয়ে পরিবেষ্টিত এই দুইটি মূর্তিতে ফারাওয়ের মাথায় ঊর্ধ্ব মিশরের সাদা মুকুট, এবং নিম্ন মিশরের দ্বি-মুকুট রয়েছে। এই মন্দিরেই মিশরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রাজা ও রাণীর মূর্তি সমান আকারে নির্মিত হয়েছে। অন্যান্য মন্দিরে রাণীর মূর্তি থাকলেও সেগুলো কখনোই ফারাওয়ের হাঁটুর চেয়ে উঁচু আকারে নির্মিত হয়নি। ব্যতিক্রমধর্মী এই মূর্তিগুলো রাণী নেফারতারির প্রতি ফারাও রামসেসের বিশেষ সম্মান ও গুরুত্ব প্রদানের পরিচায়ক। শাসনকালের ২৪ তম বছরে ফারাও রামসেস রাণী নেফারতারিকে নিয়ে আবু সিম্বেলের মন্দিরে গিয়েছিলেন।
মিশরের সকল নিদর্শনগুলোই রাজাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। রাজা-রানী, যুদ্ধ-বিগ্রহ, শাসন-শোষণ ইত্যাদি বিষয়কে কেন্দ্র করে মিশরের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো গড়ে উঠেছে। আবু সিম্বেলও তেমন একটি স্থাপনা। যেটি বিশ্ব দরবারে মিশরের মাথাকে আরও উঁচুতে ধরে রেখেছে।
GPJS
Photo: রহস্যময় শহর আবু সিম্বেল বিশ্ব ইতিহাসে মিশর একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। নীল নদ ও পিরামিড বেষ্টিত মিশর সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের সূতিকাগার। বিশ্ব সভ্যতার অনেক নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সমগ্র মিশর জুড়ে। নীল নদ ও পিরামিড ছাড়াও মিশরের আরও একটি ঐতিহাসিক স্থানের নাম আবু সিম্বেল। আবু সিম্বেল মিশরের দক্ষিণাংশে অবস্থিত একটি পুরাতাত্ত্বিক স্থাপনা, যা দুইটি বিশাল পাথর-নির্মিত মন্দির নিয়ে গঠিত। এটি আসওয়ান এর ২৯০ কিমি দক্ষিণ-পশ্চিমে লেক নাসের এর পাড়ে অবস্থিত। এই স্থাপনাটিকে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসাবে ঘোষণা করেছে। আবু সিম্বেল সহ সম্পূর্ণ এলাকাটি নুবিয়ান মনুমেন্টস নামেও খ্যাত। খ্রিস্টপূর্ব ১৩শ শতকে ফারাও ২য় রামসেসের আমলে তাঁর ও তার রাণী নেফারতারির সম্মানে ও কাদেশের যুদ্ধ এর স্মৃতি রক্ষার্থে পাহাড়ের ঘা ঘেঁষে মন্দির দুটি নির্মাণ করা হয়। বিংশ শতকে ১৯৬০ এর দশকে মন্দির দুটিকে সম্পূর্ণভাবে স্থানান্তর করা হয়, কেননা ঐ সময় নীল নদের উপরে আসওয়ান বাঁধ তৈরিতে সৃষ্ট লেক নাসের মন্দির দুটির পূর্বের এলাকাকে গ্রাস করে নেয়া শুরু করে। বর্তমানে স্থাপনাটি আসওয়ান বাঁধ এলাকার অনেক উপরে একটি কৃত্রিম পাহাড়ের উপরে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। বর্তমানে আবু সিম্বেল মিশরের অন্যতম একটি পর্যটন কেন্দ্র। প্রতি বছর হাজার হাজার লোক এই স্থানটি দর্শন করতে আসে। আবু সিম্বেলের মন্দির নির্মাণ শুরু হয় আনুমানিক ১২৪৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, এবং পরের ২০ বছর ধরে তা অব্যাহত থাকে। ২য় রামসেসের আমলে নুবিয়াতে যে ছয়টি পাথরের মন্দির তৈরি করা হয়েছিল এটি ছিলো তার মধ্যে একটি অন্যতম। সময়ের সাথে সাথে দীর্ঘ দিন পর মন্দিরটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে এবং ধীরে ধীরে এটি বালির তলায় চাপা পড়ে যায়। ৬ষ্ট খ্রিস্টপূর্বাব্দ নাগাদ মূল মন্দিরটির মূর্তিগুলির হাঁটু পর্যন্ত বালুর তলায় চলে যায়। মন্দিরটির কথা আস্তে আস্তে সবাই ভুলে যায়। ১৮১৩ সালে সুইস প্রাচ্য বিশেষজ্ঞ ইয়োহান লুডভিগ বার্কহার্ড মন্দিরের উপরের অংশ খুঁজে পান। এই আবিষ্কারের কথা তিনি ইতালীয় পরিব্রাজক জিওভান্নি বাতিস্তা বেলজোনিকে জানান। বেলজোনি মন্দির এলাকায় যান, কিন্তু মন্দিরে ঢোকার পথটি খুঁজে পাননি। ১৮১৭ সালে বেলজোনি ফিরে আসেন এবং এই বার মন্দির এলাকায় প্রবেশের পথ বের করেন। তিনি মন্দির এলাকায় মূল্যবান সব ধনসম্পদ লুটে নেন। এই স্থানটির নাম “আবু সিম্বেল” হওয়ার পিছনে রয়েছে একটি কাহিনী। আবু সিম্বেল ছিলো ঐ এলাকার এক বালকের নাম, যে ঊন-বিংশ শতকের অভিযাত্রীদের পথ প্রদর্শক হিসাবে কাজ করতো। বালুর নিচে হারিয়ে যাওয়া মন্দিরটির অবস্থান এই বালক সবচেয়ে ভালো করে জানতো। তাই এক সময় অভিযাত্রীরা মন্দির এলাকাটিকে এই বালকের নামানুসারে “আবু সিম্বেল” নামকরণ করেন। ১৯৫৯ সালে নুবিয়ার পুরাকীর্তিসমূহকে রক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা শুরু হয়। আসওয়ান বাঁধ নির্মাণের ফলে সৃষ্ট লেক নাসের এর পানির তলায় এই পুরাকীর্তিগুলো তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিলো। আবু সিম্বেলের মন্দিরগুলো রক্ষার কাজ শুরু হয় ১৯৬৪ সালে। প্রায় ৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচে ১৯৬৪ হতে ১৯৬৮ সালের মধ্যে এই মন্দিরগুলোকে উঁচু স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়। এজন্য পুরো মন্দির এলাকার সব স্থাপনাকে বড় বড় টুকরা করে কেটে আলাদা করে নীল নদের বর্ধমান তীর হতে ২০০ মিটার দূরে ও প্রায় ৬৫ মিটার উচ্চ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়। সফলভাবে মন্দির স্থাপনাকে স্থানান্তর করার এই প্রকল্পকে পুরাতাত্ত্বিক প্রকৌশলের সেরা সাফল্যগুলোর মধ্যে গণ্য করা হয়। মন্দির স্থাপনাতে দুইটি মন্দির রয়েছে। এদের মধ্যে বড়টি মিশরের তদানীন্তন প্রধান তিন উপাস্য দেবতা রা হারখতি, প্তাহ, এবং আমুন এর উদ্দেশ্যে নিবেদিত। এই মন্দিরটিতে রামসেসের চারটি বড় মূর্তি রয়েছে। ছোট মন্দিরটি দেবী হাথর এর উদ্দেশ্যে নিবেদিত। হাথরের প্রতিমূর্তি হিসাবে রামসেসের প্রিয় স্ত্রী নেফেরতারির মূর্তি এই মন্দিরে শোভা পাচ্ছে। আবু সিম্বেলের বৃহত্তর মন্দিরটি তৈরি করতে সময় লেগেছিলো ২০ বছর। ফারাও মহান রামসেসের রাজত্বের ২৪তম বছরে ১২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়। আমুন রা, রা-হোরাখতি, এবং পতাহ দেবতা, এবং রামসেসের উদ্দেশ্যে এই মন্দিরটি উৎসর্গ করা হয়। রামসেসের রাজত্বকালে নির্মিত মন্দিরসমূহের মধ্যে এটিকেই সবচেয়ে সুন্দর ও রাজকীয় বলে গণ্য করা হয়। উচ্চ ও নিম্ন মিশরের দ্বৈত মুকুট খচিত ফারাও রামসেসের ২০ মিটার উঁচু চারটি মূর্তি মন্দির এলাকায় অবস্থিত। মন্দির এলাকাটি ৩৫ মিটার প্রশস্ত। সবার উপরে সূর্যের উপাসক ২২টি বেবুনের মূর্তি প্রবেশপথকে ঘিরে রেখেছে। ফারাওয়ের এই বিশালাকার মূর্তিগুলো যে পাহাড় কেটে মন্দির তৈরি হয়েছিলো, সেই পাহাড়ের পাথর কেটেই নির্মাণ করা হয়েছে। সবগুলো মূর্তি সিংহাসনে বসে থাকা রামসেসের প্রতিনিধিত্ব করছে। প্রবেশপথের বাম দিকের মূর্তিটি একটি ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বর্তমানে কেবল মূর্তিটির নিচের অংশ অক্ষত রয়েছে। এর সামনেই ভেঙে পড়া মূর্তির মাথা ও দেহ পড়ে রয়েছে। ফারাওয়ের বড় মূর্তিগুলোর পাশেই রয়েছে ছোট ছোট কিছু মূর্তি, যাদের উচ্চতা ফারাওয়ের হাঁটুর চেয়ে কম। এগুলো রামসেসের প্রধান স্ত্রী নেফারতারি, এবং রাজমাতা রাণী মুত-তুই, রামসেসের প্রথম দুই পুত্র আমুন-হের-খেপেশেফ ও রামসেস বি, এবং ফারাওয়ের প্রথম ছয় কন্যা বিন্তানাথ, বেকেতমুত, নেফেরতারি, মেরিতামেন, নেবেত্তাউই, এবং ইসেত্নোফ্রেত এর মূর্তি। প্রবেশদ্বারটিতে রয়েছে বাজপাখির মতো মাথাবিশিষ্ট দেবতা রা হারাখতিকে উপাসনারত ফারাও রামসেসের ছবি। মন্দিরের ভিতরে প্রাচীন মিশরের অন্যান্য মন্দিরের মতোই ত্রিকোণাকার কাঠামো ব্যবহার করা হয়েছে, যাতে কক্ষগুলোর আকার প্রবেশ পথ থেকে মূল শব কক্ষ পর্যন্ত আস্তে আস্তে কমতে থাকে। মন্দির অঙ্গনের গঠন বেশ জটিল ও বহু পার্শ্ব কক্ষবিশিষ্ট। প্রোনাস বা হাইপোস্টাইল হল হলো ১৮ মিটার দীর্ঘ ও ১৬.৭ মিটার প্রশস্ত, এবং আটটি প্রকাণ্ড মূর্তি সদৃশ স্তম্ভ বিশিষ্ট। এই স্তম্ভগুলোতে পর জগতের দেবতা অসিরিস এর চেহারা খোদাই করা, যা ফারাও এর অমরত্বের প্রতীক। বাম দিকের দেয়ালের কাছের বড় মূর্তিগুলো ঊর্ধ্ব মিশরের সাদা মুকুট খচিত, আর ডান দিকের মূর্তিগুলো নিম্ন মিশরের দ্বৈত মুকুট পরে আছে। প্রোনাস হলের দেয়ালচিত্রগুলো ফারাওয়ের বিভিন্ন সামরিক অভিযানের উপরে অঙ্কিত। অধিকাংশ ছবিতেই প্রকাশ পেয়েছে কাদেশের যুদ্ধের কথা, সিরিয়ার ওরন্তেস নদীর পারে যেখানে মিশরের ফারাও হিট্টীয় বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করেছিলেন। সবচেয়ে বিখ্যাত চিত্রটিতে দেখানো হয়েছে, ফারাও তাঁর রথে বসে পলায়নোদ্যত শত্রুদের দিকে তীর নিক্ষেপ করছেন। অন্য ছবিতে লিবিয়া ও নুবিয়ার সাথে যুদ্ধে মিশরের বিজয় দেখানো হয়েছে। আবু সিম্বেল মন্দির এলাকায় অবস্থিত হাথর ও নেফারতারির মন্দিরটি মূল রামসেসের বৃহত্তর মন্দির হতে প্রায় ১০০ মিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। এটি দেবী হাথর, এবং ২য় রামসেসের প্রধান স্ত্রী নেফারতারির উদ্দেশ্যে নিবেদিত। রাণীর উদ্দেশ্যে মন্দির উৎসর্গ করার এই ঘটনাটি মিশরের ইতিহাসে দ্বিতীয়। এর আগে আখনাতেন তাঁর স্ত্রী নেফারতিতির উদ্দেশ্যে মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। মন্দিরটির সম্মুখভাগের দেয়াল পাথর খোদাই করে নির্মিত। দুই পাশে রয়েছে দুই গুচ্ছ মূর্তি, আর তাদের মাঝে রয়েছে বৃহৎ প্রবেশদ্বার। মূর্তিগুলো প্রায় ১০ মিটার উঁচু। এগুলো ফারাও ও রাণীর মূর্তি। প্রবেশ দ্বারের অন্য পাশে রয়েছে ফারাওয়ের দুইটি মূর্তি। রাণী ও রাজার আরও কয়েকটি মূর্তি দিয়ে পরিবেষ্টিত এই দুইটি মূর্তিতে ফারাওয়ের মাথায় ঊর্ধ্ব মিশরের সাদা মুকুট, এবং নিম্ন মিশরের দ্বি-মুকুট রয়েছে। এই মন্দিরেই মিশরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রাজা ও রাণীর মূর্তি সমান আকারে নির্মিত হয়েছে। অন্যান্য মন্দিরে রাণীর মূর্তি থাকলেও সেগুলো কখনোই ফারাওয়ের হাঁটুর চেয়ে উঁচু আকারে নির্মিত হয়নি। ব্যতিক্রমধর্মী এই মূর্তিগুলো রাণী নেফারতারির প্রতি ফারাও রামসেসের বিশেষ সম্মান ও গুরুত্ব প্রদানের পরিচায়ক। শাসনকালের ২৪ তম বছরে ফারাও রামসেস রাণী নেফারতারিকে নিয়ে আবু সিম্বেলের মন্দিরে গিয়েছিলেন। মিশরের সকল নিদর্শনগুলোই রাজাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। রাজা-রানী, যুদ্ধ-বিগ্রহ, শাসন-শোষণ ইত্যাদি বিষয়কে কেন্দ্র করে মিশরের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো গড়ে উঠেছে। আবু সিম্বেলও তেমন একটি স্থাপনা। যেটি বিশ্ব দরবারে মিশরের মাথাকে আরও উঁচুতে ধরে রেখেছে।
gpjs
Post a Comment