দি জ্যাকেল।
কার্লোস দি জ্যাকেল সম্ভবত ওসামা বিন লাদেন পুর্ব যুগের সবচাইতে গ্ল্যামারাস সন্ত্রাসী। হলিউডেও কার্লোস দি জ্যাকেলকে নিয়ে মুভী বানানো হয়েছিল, উইল স্মিথ (জ্যাকেল চরিত্রে) এবং রিচার্ড গিয়ার অভিনীত 'দি জ্যাকেল' মুভীটা ব্লক বাস্টার হয়েছিল।
ভিয়েনায় ১১ জিম্মি সহ ওপেক হেড কোয়ার্টার দখল, ৭২সালে অলিম্পিক গেমসে এথলেটদের জিম্মি করে ২ জন ইজরায়েলী জিম্মিকে হত্যা, অসংখ্য রাজনৈতিক গুপ্ত হত্যার মাধ্যমে নিজেকে বিশ্বের মোস্ট ওয়ানটেড ক্রিমিন্যাল বানিয়ে ফেলে।
ইলিচ রামিরেজ সানচেজ, এটাই কার্লোসের সত্যিকারের নাম। ১৯৪৯সালে ভেনিজুয়েলার কারাকাসে জন্ম নেয় কার্লোস। বাবা উগ্রবামপন্থি হওয়ায় তার নাম লেনীনের নামানুসারে রাখে, তার আরেক ভাইএর নাম রাখা হয় ভ্লাদিমির (ভ্লাদিমির ইলিচ-লেনীনের আসল নাম), গ্রেফতার হবার সময় কার্লোসের ব্যাক্তিগত সম্পত্তির মাঝে পাওয়া একটা থ্রিলার বইয়ের নাম ছিল "দি জ্যাকেল' দি গার্ডিয়ান তাকে এ নামে ডাকা শুরু করলে অন্যান্য অভিজাত পত্রিকারাও তার আসল নাম মুছে তাকে জ্যাকেল বানিয়ে দেয়।
বাবার প্রচ্ছন্নতায় কারাকাসে স্কুলে থাকতেই উগ্রবামপন্থিদের সাথে জড়িয়ে যায় ইলিচ, মাতৃভাষা স্প্যানিশ ছাড়াও আরবী, রুশ, ফ্রেঞ্চ এবং ইংরেজীতে দক্ষতা পায়। ১৭বছর বয়সে রাজনৈতিক বাবার সাথে ত্রি-মহাদেশিয় বামপন্থি সম্মেলনে যোগ দিলে আরো উগ্রপন্থি হয়ে ওঠে ইলিচ। সন্দেহ করা হয় এই বছরেই সে কিউবায় এক গোপন গেরীলা ট্রেনিং কেন্দ্র থেকে মার্ক্সিস্ট গেরীলা ট্রেনিং পায়। বাবা মায়ের ডিভোর্স হলে মায়ের সাথে ইংল্যান্ডে চলে আসে। লন্ডনে স্কুলে পড়া শেষে রাশিয়ার প্যাট্রিক লুমুম্বা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়। ১৯৭০সালে ইউনিভার্সিটি তাকে বহিষ্কার করলে উগ্র বাম পন্থি আরব সংগঠন পপুলার ফ্রন্ট অফ প্যালেস্টাইনী লিবারেশন (PFLP) এর হয়ে জর্ডানে গেরীলা ট্রেনিং নেয়। জর্ডানেই ইলিচ সানচেজ ছদ্মনাম পায় কার্লোস। বিভিন্ন কারনে জর্ডান সরকার গেরীলাদের বহিষ্কার করলে কার্লোস ইংল্যান্ডে ফিরে এসে ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েস্টমিনিস্টারে পড়াশুনা শেষ করে।
৭৩ সালে PFLPএর হয়ে বিখ্যাত এক ব্রিটিশ ব্যাবসায়ীকে হত্যার চেষ্টা করে কার্লোস, মোসাডের চালানো এক এসাসিনেশনে একজন আরব নাট্যকর্মী (গোপনে PFLP কর্মি)কে হত্যার বদলা নিতেই এই হত্যা চেষ্টা। এর মধ্যেই লন্ডনের এক ব্যাঙ্কে ব্যর্থ বোমা হামলা এবং প্যারিসের এক ইজরায়েলী মতাদর্শি পত্রিকা অফিসে গাড়ি বোমলা হামলা চালায় কার্লোস। এর পরে এক ফিলিস্তিনি রেস্তোরা তে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ২জন কে হত্যা আর ৩০জনকে আহত করে। ৭৫এর জানুয়ারীতে প্যারিসের এক এয়ারপোর্টে ২ দিন রকেট চালিত গ্রেনেড হামলা চালায়। ঐ বছরের জুনে প্যারিসে কার্লোসের সহযোগী ধরা পড়লে ফরাসী পুলিশ তার অবস্থান জানতে পারে। গভীর রাতে তার প্যারিসের বাড়িতে ফরাসী পুলিশ এক পার্টির মাঝে উপস্থিত হলে কার্লোস দুজন ডিটেকটিভকে হত্যা করে পালিয়ে যান ব্রাসেলস হয়ে বৈরুতে।
৭৫সালের ২০ ডিসেম্বর ৬জনের সন্ত্রাসী দল নিয়ে কার্লোস ভিয়েনাতে ওপেক সদর দপ্তরে হামলা চালায়। সম্মেলন চলাকালীন এই হামলায় কার্লোস ওপেক সদর দপ্তর দখল এবং প্রায় ৬০জন ওপেক নেতাকে জিম্মি করে। অস্ট্রিয়ান রেডিও টিভি থেকে প্যালেস্টাইনি গেরীলাদের পক্ষে তার দাবী নামা প্রতি ২ঘন্টা অন্তর প্রচারিত হতে থাকে। দুই দিন পরে চাপ দিয়ে অস্ট্রিয়ান সরকারের কাছে থেকে বিমান নিয়ে ৪০ জিম্মি সহ কার্লোস আলজিয়ার্সে পালিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা সাফল্যের সাথে পালিয়ে যায় এবং জিম্মি সহ বিমান লিবিয়ায় অবতরন করে। সফল ভাবে এই ওপেক অভিযান রাতা রাতি তাকে টপ-রেটেড সন্ত্রাসী বানিয়ে দেয়। প্যালেস্টাইনী গেরীলাদের পক্ষে কাজ করলেও প্রকৃতপক্ষে কার্লোস একজন মার্সেনারী ছিল। ধারনা করা হয় এই অভিযানের জন্যে কার্লোসকে কোন অজ্ঞাত আরব-প্রেসিডেন্ট ২৫-৩০মিলিয়ন ডলার দাম দেয়। ইরান এবং সৈদি আরবের তেল মন্ত্রিকে হত্যার দায়ে প্যালেস্টাইনীরা তাকে বরখাস্ত করে। এছাড়াও অসাধুতার এবং আদর্শহীনতার অভিযোগ ছিল।
৭৬সালে যুগোস্লোভীয়ার একবার এরেস্ট হলেও পড়ে ছাড়া পেলে কার্লোস এডেনে স্থায়ী হয় এবং সিরিয়, লেবানীজ এবং জার্মান বিদ্রোহীদের নিয়ে অর্গানাইজেশন অফ আরব আর্মড স্ট্রাগল নামের নিজের সন্ত্রাসী বাহিনী তৈরি করে। এখানেই পুর্ব জার্মানী আর রুমানিয়ান সিক্রেট সার্ভিসের টাকা খেয়ে কার্লোস মিউনিখে এক রেডিও স্টেশন উড়িয়ে দেয়। ১৯৮২ সালে আবার ভাড়াটে সন্ত্রাসী হিসাবে ফ্রান্সের পারমানবিক কেন্দ্রে হামলা চালায়।
কার্লোসের স্ত্রী মাগদালেনা কপ (সেও সন্ত্রাসী) ফ্রান্সে এরেস্ট হলে কার্লোসের দল একের পর এক বেপোরয়া আর নির্মম বোমা হামলা চালাতে থাকে।
৮৩ সালে সন্ত্রাসীদের ঘাটিতে ফরাসী বিমান হামলার জবাবে ফ্রান্সে বুলেট ট্রেনে বোমা হামলা চালিয়ে পত্রিকা অফিসে চিঠি দিয়ে দায় শিকার করে কার্লোস দ্য জ্যাকেল। এই ঘটনার পর পর আন্তর্জাতিক চাপে ইস্টার্ন ইয়োরপিয়ান রাস্ট্রগুলো কার্লোসের সাথে বন্ধুত্ব শেষ করে দেয়। লিবিয়া, ইরাক এবং কিউবার মত বন্ধুরাও কার্লোসকে অস্বীকার করে। সিরিয়া শর্ত দিয়ে আশ্রয় দিলে কন্যা এবং স্ত্রীকে নিয়ে দামেস্কতে স্থায়ী হয় সে। সিরিয়া কয়েকবছর পরে তাকে আশ্রয় দিতে অস্বীকার করলে জর্ডানে আশ্রয় নেয় কার্লোস। মুলত কোল্ড ওয়ারের সময়ে মার্কিন মদদ পুষ্ট শক্তিগুলোতে হামলা হওয়ায় ধারনা করা হয় কেজিবিও হয়তো কার্লোসের বন্ধু ছিল।
৮০র দশকে মার্কিন এবং ফরাসী ইন্টালিজেন্স নানা ভাবে জর্ডানকে কার্লোসের ব্যাপারে চাপ দিতে থাকে। কার্লোসের নিরাপত্তার জন্যে জর্ডান সরকার তাকে বডি গার্ড সহ এক ভিলা দেয়। কিন্তু ১৪অগাস্ট ১৯৯৪সালে নিজের বডি গার্ডের তাকে ঘুমের ওষুধ পুশ করে বেধে ইন্টালিজেন্সের তুলে দেয়।পরে তাকে প্যারিসে আনা হয়। প্যারিস আদালত তাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়।
২০০৩ সালে কারাগার থেকে তার লিখা বই প্রকাশিত হয় প্যারিসে Revolutionary Islam বইতে সমাজতন্ত্রের উগ্র শ্রেনী শত্রু খতম থিওরীর সাথে ইসলামিক ধর্মান্ধতার সংমিশ্রনে বিচিত্র তত্ব লিখে। এই বইতে ওসামা বীন লাদেনের আমেরিকা হামলাকে অনেক প্রসংসা করে লিখে এছাড়াও সাদ্দাম হোসেন কে লাস্ট আরব নাইট উপাধিতে সম্বোধন করে কার্লোস দ্যা জ্যাকেল। এছাড়া ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো সানচেজের সাথেও তার চিঠিতে যোগাযোগ হয়েছিল।
Post a Comment